শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১০

আবেগের আঘাতে আক্রান্ত লাল-সবুজ

             এমন নয় যে, কথাটি এই প্রথম বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে আগেও। কাজ হয় নি কিছু। আজ যখন আবারো বলবো, পঁছন্দ হবেনা অনেকেরই। কারো কারো কাছে মনে হবে বেহুদা বক্ওয়াস্। তবুও বলবো আমি এবং চিৎকার করেই বলবো। কেউ শুনলো কি শুলো না, মানলো কি মানলো না, সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না, আমাদের কাজ শুধু পৌঁছে দেয়া, ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।


           আমরা, বাঙালিরা আবেগ প্রবণ জাতি। আবেগের বেগটাও আবার বেশি। আমাদের এই মাত্রাতিরিক্ত আবেগের সাথে দুর্বল বিবেকের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হেরে যায় বিবেক, আবেগের কাছে। সময়ের স্রোতে পাল তুলে দিয়ে বসে থাকি আমরা, নিরবে। যাচ্ছি কোথায়, না ভেবেই। গন্তব্য ঠিক আছে কি না, না জেনেই। জোশের সাথে হুশ্ ঠিক থাকা দরকার। প্রায়ই আমাদের থাকে না। অনাহারির মুখে খাবার তুলে দেবো, ভাল কথা। কিন্তু ভাই বোন-স্ত্রী সন্তানের মুখের আহার কেড়ে নিয়ে? বাইরের মেহমানকে সম্মান জানাবো, ভাল কথা। তাই বলে কি তাকে পিতার আসনে বসিয়ে দিয়ে? মাকে অপমান করে? এমন উদ্ভট কান্ড-কারখানা যদি করে কেউ, ব্যক্তি জীবনে, তাহলে তার শুভ বুদ্ধির প্রত্যাশাই করার থাকবে শুধু। কিন্তু ব্যাপারটি যদি হয় সমষ্টিক, এর এ্যাফেক্ট যদি এসে পড়ে পুরো জাতির উপর, তাহলে এ নিয়ে কথা বলবার এবং আপত্তি জানাবার যথেষ্ট কারণ ও যৌক্তিকতা রয়েছে।


দুই//
            মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে আনুসাঙ্গিক কিছু প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার। এমন নয় যে, একাত্তরের আগে আমরা খেতে পরতে পারতাম না। তবে কেন একাত্তরের প্রয়োজন ছিলো? এমন তো নয় যে, বাহান্নর আগে আমরা বাংলায় কথাই বলতে পারতাম না! বাংলা বললে কেউ এসে ঠুটি চেপে ধরতো! তবুও বাহান্নর প্রয়োজন ছিলো কেন? সাতচলি¬শের আগে কি আমরা আমাদের বাড়িঘরে থাকতে পারতাম না? তবে কেন  সাদাদের বিরুদ্ধে লড়ে রক্ত ঝরানো? কেন তবে সাতচল্লিশের পার্টিশন?


           জবাব অনেক। আবার একটাই জবাব, অধিকার ও আত্মমর্যাদা। মূলত এই দুটি শব্দের জন্যই সাতচলি¬শ, বাহান্ন এবং একাত্তুরের জন্ম। লক্ষ লক্ষ মানুষ যুগেযুগে তাদের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে আমাদের অধিকার, আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচবো বলে। এখন আমরা যদি সেটা ধরেও রাখতে না পারি, আমরা যদি আমাদের অহংকারের সফেদ চাদরে কালো দাগ বসিয়ে দেই, যদি কলংকের তিলক এঁকে দেই আত্মপরিচয়ের সনদে, তাহলে সেটা যে আমাদের জাতিগত আত্মহত্যাই হবে, কখনো ভেবে দেখেছি?


তিন//
        সারাবিশ্বে একটি জ্বর এসেছে। চার বছর পর পরই আসে। বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বর। ঝড়ের মতো জ্বর। এ জ্বরে আক্রান্ত বিশ্বের ৫শ কোটি মানুষ। আমরা বাংদেশিরাও পিছিয়ে নেই। লাফালাফিটা আমরাও কম করছিনা। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে নেই। অদূর ভবিষ্যতে কখনো যেতে পারবে, এমন দুঃস্বপ্ন দেখার মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও উতসাহে-উতসবে কমতি নেই কোনো। লাফালাফিটা আমরা ঠিকই করে যাচ্ছি। ছাগলের সেই তৃতীয় বাচ্ছাটির মতো। ছাগলের দুই বাচ্ছা দুধ খেয়ে লাফায় আর তৃতীয়টি এমনিতেই তিরিং বিরিং করে। বাংলাদেশের মানুষ আজ  আওয়ামীলীগ-বিএনপি নয়, ব্রাজিল আর্জেন্টিনায় বিভক্ত। কোনো এক বিকেলে ম্যারাডোনাকে বলা হয়েছিলো আপনি কি জানেন বাংলাদেশে আপনার কয়েক কোটি ভক্ত রয়েছে? তিনি বিষ্মত হয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ! সেটা আবার কোথায়? কখনো নাম শুনিনি তো! আর পেলেকে এখনো জিজ্ঞেস করার সুযোগই পাওয়া যায়নি যে, জনাব, বাংলাদেশ নামের ছোট্ট একটি দেশ আছে। সেখানে আপনার ব্রাজিলের রয়েছে অসংখ্য সমর্থক। আপনি কি এটা জানেন! তার পরও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ল্যাটিন আমেরিকার এই দুই দেশের নামে কুরবান।


          অবশ্য এদেশের ফুটবল প্রেমী মানুষ ব্রাজিলকে সমর্থন করলো কি আর্জেন্টিনাকে করলো, পর্তুগালকে করলো নাকি আইভরিকোস্টকে, আমাদের কিছু যায় আসে না। করুক সমর্থন যার যাকে খুশি। রাত জেগে, সারারাত, খেলা দেখুক। পেটের দায়ে ঘুম পূর্ণ না করেই সকাল ৮ টায় বেরিয়ে যাক অফিসে, দোকানে, কর্মস্থলে। সারাদিন কাঠবেড়ালীর মতো চেহারাটাকে ভোতা বানিয়ে টেবিলে বসে ঝিমাক। অথবা চোখ টেনে জেগে থেকে গত রাতের খেলা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন করুক। বিশেষজ্ঞ মতামত দিক। খেলার মধ্যখানে ২০ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের চৌদ্দগোষ্ঠির রুহের উপরও কিছু ঝাড়ুক, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। ফেলুক পানি প্রিয় দলের পরাজয়ে। করুক চিৎকার যত জোরে ইচ্ছে। গলার রগটি কেবল না ছিড়লেই হলো।


চার//
            মূল কথায় চলে আসি। এই মুহুর্তে বাংলাদেশে সব'চে রমরমা ব্যবসাটির নাম পতাকা ব্যবসা। এক জরিপে দেখা গেছে সারাদেশে ইতোমধ্যে ৩০ লাখেরও বেশি পতাকা তৈরি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এই সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এগুলো আমাদের লাল-সবুজের পতাকা নয়। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার। কিছু আছে ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানীর। তবে অধিপত্য ল্যাটিন আমেরিকারই। কিছুদিন আগে ইউরোপের আকাশটা ভয়ংকরভাবে ছেয়ে গিয়েছিলো ছাই মেঘে। আইসল্যান্ড থেকে নির্গত আগ্নেয়গিরির লাভায় জন্ম হয়েছিলো ভয়াবহ এক অবস্থার। এক অর্থে তারচেও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের আকাশটা আজ ছেয়ে গেছে ব্রাজিলÑআর্জেন্টিনার পতাকায়! আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম আকাশে উড়ছে অন্যদেশের জাতীয় পতাকা! ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে একটি চমৎকার পতাকা দিয়ে গেছে আমাদের। দিয়ে গেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখন্ড, স্বাধীন করে। সঙ্গত কারণে এবং অবশ্যই বিধিবদ্ধ কারণে, বাংলাদেশের আকাশে একমাত্র লাল সবুজ পতাকাই উড়ার অধিকার রাখে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার নয়। অন্য কারো নয়। এই ফাঁকে বলে রাখা যায়, বাংলাদেশস্থ বিদেশি দূতাবাসগুলোতে স্ব স্ব দেশের জাতীয় পতাকা টানানো হয়। হতেই পারে। বাংলাদেশের সাথে অন্য এক বা একাধিক দেশের দ্বি-পাক্ষিক বা বহুপক্ষীয় কোনো চুক্তি বা সভা হলে সেখানে সকল দেশের পতাকা টানানো হয়। সব দেশেই হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে নিজ দেশের পতাকাকে রাখতে হয় মধ্যখানে এবং একটু উঁচুতে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কারণে অন্যদেশের পতাকা টানানোর কোনো অধিকার তো কাউকে আমার সংবিধান দেয় নি।


         আমি জানি না আমাদের আইনের ধারা এক্ষেত্রে কী বলে? আইনে যদি বলা হয়ে থাকে স্বাধীন বাংলার আকাশে অন্যদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো যাবে, তাহলে তীব্র ভাষায় আমরা বলবো, এ আইন আমরা মানি না। আমরা আমাদের লাল সবুজের স্থানে অন্য কাউকে সহ্য করতে রাজি নই। তবে আশা করা উচিৎ এদেশে এমন উদ্ভট কোনো আইন নেই। এবারে প্রশ্ন হলো, স্বাধীন এই দেশে ভিন্নদেশের জাতীয় পতাকা টানানো বৈধ কি না! যদি বৈধ না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপক্ষ নিরব কেন? সরকারের কাছে কি মনে হচ্ছেনা এই পতাকা সংস্কৃতি বন্ধ করা দরকার? এক বছর পর যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসবে, তখন অতি উৎসাহী কোনো সমর্থক যদি তার পছন্দের দল পাকিস্থানের চাঁদতারা খচিত পতাকাটি আমার দেশে টানিয়ে দেয়, তখন নীতিগতভাবে কি কিছু বলার থাকবে? আইনগতভাবে কি কিছু করার থাকবে? তার পক্ষে কি কোনো জাদরেল আইনজীবি দাঁড়িয়ে যাবেন না? বলবেন না, খেলার সমর্থক হিসেবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা পাকিস্থান সবগুলোর পতাকা টানানোর হুকুমই সমান হবার কথা। এদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা টানানো বৈধ হলে পাকিস্থানেরটা অবৈধ হবে কেন? তখন কী হবে অবস্থা? আর এভাবে আইনের ফাঁক গলে বর্বর পাকিস্থানিদের অই পতাকা, যেটি আমরা ছিন্ন ভিন্ন করে ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে এসেছি, যদি আমাদের আকাশে কিছু সময়ের জন্যও বৈধতা পেয়ে যায়, তাহলে একাত্তরের শহীদদের কাছে কী জবাব দেবো আমরা?


পাঁচ//
         আমি জানি, এবং বেশ ভাল করেই জানি, আমি যদি আমার বাড়ি বা গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দেই, তাহলে বিধিগত কারণেই আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাবে। কারণ, ন্যূনতম প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার নিচের কারো পতাকা ব্যবহারের সাংবিধানিক সুযোগ নেই। আমরা সাধারণ মানুষ পতাকা ব্যবহারের সুযোগ পাই ১৬ই ডিসেম্বর ২৬শে মার্চের মত কয়েকটি দিবসে। এটা ঠিক আছে। জাতীয় পতাকার একটা মর্যাদা আছে। যেন-তেন লোক পতাকা ব্যবহার করলে পতাকার আর ইমেজ থাকলো কই! আমার দেশের অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার তাদের ভয়াবহ দেশপ্রেমে উতলা হয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মাথার উপরে লাল-সবুজের পতাকাও লাগিয়ে রেখেছেন। আইনের চোখে তো এটারও বৈধতা নেই। জাতীয় পতাকা তো খেলা করার বিষয় নয়।


          যারা আমার স্বাধীন দেশে, বুঝে হোক আর না বুঝে, আবেগে হোক আর হুজুগে, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার, অন্যদেশের জাতীয় পতাকা টানিয়ে রেখেছে, তাদেরকে সতর্ক করা দরকার। এই অশুভ কালচারের বিরুদ্ধে সরকারের নমনীয়তা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। ৩০ লাখ লোক জীবন দিয়ে কিনে দিয়ে গেছে আমাদের পতাকাটি। এই পতাকার সাথে বা স্থলে অন্যদেশের পতাকা উড়ানো তো আমাদের পতাকাটিকে অপমান করা। আর লাল সবুজের চমৎকার এই পতাকাটিকে অপমান করার কোনো অধিকারই কারো নেই। কারোই নেই।

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০১০

দিন যায় কথা থাকে

 

       ভাগ্যিস তারা বাংলা বুঝেন না। তা নাহলে সম্ভবত সংসদের অধিবেশন চলা অবস্থায়ই আমাদের মুখে থু থু ছিটিয়ে বেরিয়ে আসা উচি্ত কিনা-বিবেচনা করতেন। আমি কমনওয়েলথ প্রতিনিধি দলের কথাই বলছি। বড়বেশি আগ্রহ ও কৌতূহল নিয়ে তারা গিয়ে বসেছিলেন আমাদের সংসদ গ্যালারীতে। উদ্দেশ্য, আমাদের সংসদীয় কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ করা। আর বেছে বেছে সেই দিনটিকেই আমরা আলাদা করলাম ছূড়ান্ত নোংরামীটা করবার জন্য। 
উনিশ’শ নব্বই সালে গণতন্ত্র পূন:প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে আজ অবদি আমাদের সংসদ কখনো জাতির আশা-আকাংখার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের সংসদ সদস্যরা তাদেরই তৈরি রুলস অব প্রসিডিউরকে কোনো কালেই পাত্তা দেননি। যার যেমন ইচ্ছে, তেমনই বক্তৃতা করেন সংসদে। ফ্রি স্টাইল বক্তৃতা। প্রসঙ্গ যত অরুচিকরই হোক, বাক্য মত নোংরাই হোক, তাদের মুখে কিছুই আটকায় না। আর যখন যিনিই স্পীকারের আসনে বসা থাকেন, তিনি থাকেন অসহায়। বাজে মন্তব্য করার কারণে কাউকে তিনি ভর্তসনা করতে বা অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করেও দিতে পারেন না। সেই ক্ষমতা তাকে আমরা দেইনি। আজকের প্রেক্ষাপটে স্পীকারের হাতে সেই ক্ষমতা দেয়া উচি্ত কিনা, ভেবে দেখা যেতে পারে। অবশ্য তার আগে যা ভেবে দেখা যেতে পারে, তা হলো, দলীয় টিকেটে নির্বাচিত এমপিদের মধ্য হতে স্পীকার নির্বাচন করার বিকল্প কোনো উপায় খুঁজে বের করা যায় কি না। 
দুই \
        কয়েক বছর আগে তিন দিনের জন্য তাবলীগে গিয়েছিলাম। সাত/আটজন বন্ধু-বান্ধবসহ। আমীর সাহেব বললেন, “ভাই আমরা আল্লাহর রাস্তায় বের হয়েছি। আমরা একে অন্যের কাছে সওয়াল তো করবোই না, এমনকি সওয়ালের ভান্ও ধরবো না।” রাতে খেতে বসেছি। আমার সাথী (বন্ধু) আমাদের প্লেট থেকে মাছের টুকরো নিয়ে গেলো। বললাম, কিরে! আমীর সাহেবের কথা তোর মনে নেই? সে বললো, “খুব মনে আছে। আমীর সাহেব চাইতে নিষেধ করেছেন, জোর করে নিয়ে যেতে তো আর নিষেধ করেন নি!”
      আমাদের সংসদীয় রীতি হচ্ছে সংসদে কেউ মিথ্যে বললে সেটাকে মিথ্যে বলা যাবেনা। সংসদের আদবের বরখেলাফ হবে। বলতে হবে অসত্য। এমন কারো ব্যাপারে বাজে মন্তব্য করা যাবেনা, সংসদে এসে যার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ নেই। আমরা লক্ষ্য করে থাকি আমাদের কিছু কিছু সংসদ সদস্যদের অবস্থা আমার অই বন্ধুটির মতো। তারা একজন অন্যজনকে মিথ্যেবাদী বলেন না, তবে চুর-ডাকাত সন্ত্রাসী বলেন ঠিকই। এমন ব্যক্তিবর্গ নিয়ে নোংরা মন্তব্য করেন, এই জীবনে যাদের সংসদে এসে আত্মপক্ষ সমর্থন করার ক্ষমতা নেই। কবর থেকে উঠে সংসদে এসে জবাব দেয়ার ক্ষমতা কারো থাকে না। বিটিভি ওয়ার্ল্ডের সৌজন্যে এদেশের খেটেখাওয়া মানুষ সংসদ অধিবেশন দেখে থাকে। আর আমাদের মাননীয় সাংসদগণ যখন স্বরূপে আবর্তিত হন, তারা যখন মৃত নেতাদের কবর থেকে টেনে-হেঁছড়ে বের করে আনার চেষ্টা করেন, তারা যখন জীবিত নেতাদের কুতসিত ভাষায় গালি দেন, নেত্রীদের শাড়ীর আঁচল ধরে টানাটানি করেন, তখন সেটা দেখে দেশের সাধারণ জনগণ লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয় টেলিভিশনের পর্দা থেকে। আর মনে মনে ভাবে, প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে গালাগালি করার দরকার কী? কোনো বস্তির পাশে খোলা আসমানের নিচেই তো এই কর্মটি করা যায়।
তিন \
          দীর্ঘ ৬৩ কার্যদিবসে অনুপস্থিত থাকার কৃতিত্ব দেখানোর পর বিএনপি সংসদে যোগদান করেছে। আমরা দেশবাসী আশাবাদী হয়েছি। একটি প্রাণবন্ত ও কার্যকর সংসদ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি। আমরা ভেবেছি সংসদে আমাদের জাতীয় সমস্যাগুলো আলোচিত হবে। আমরা আশাহত হলাম। গত নির্বাচনের পরে সুজন সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছিলেন “বর্তমান সংসদটা কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। এই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জাতি কতটুকু কী পাবে, বলা মুশকিল।” আর অতি সম্প্রতি দেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও কলামিষ্ট জনাব এবিএম মুসা বলেছেন, “বর্তমান সংসদের ৮০% সাংসদই অযোগ্য।” দেশের দল নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবিরা আমাদের সংসদ সদস্যদের সুস্থ মানসিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। তোলারই কথা। আমরা হতভম্ব হয়ে লক্ষ্য করছি আমাদের এমপি মহোদয়গণ কে কাকে কত জঘন্য গালি দিতে পারেন, কে কার থেকে নোংরা শব্দ ব্যবহার করতে পারেন, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন। তারা ভেবে দেখেন না সংসদ কারো বাবার টাকায় পরিচালিত হয় না। সংসদ পরিচালিত হয় এদেশের খেটেখাওয়া মানুষের ঘাম ঝরানো টাকায়। তারা ভেবে দেখেন না এদেশের অনেক মানুষ রিক্সা চড়ায় সামর্থ রাখেনা কিন্তু তাদেরকে দিয়েছে ডিউটি ফ্রি গাড়ি। সংসদে নিয়ে গরীবের কথা বলবার জন্য। এই গাড়ি হাঁকিয়ে সংসদে গিয়ে খিস্থিখেউড় করবার জন্য নয়।
      সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধীদলকে বলা হয় ছায়া সরকার। বিরোধীদলের গঠনমূলক সমালোচনাকে আমলে নিয়েই দেশ পরিচালনা করবে সরকার। এটাই নিয়ম। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? সাপ আর নেউলও মাঝে-মধ্যে একত্র হয় কিন্তু আমাদের সরকার ও বিরোধী দল কখনো এক হয় না। দেশ নয়, দলই তাদের কাছে মূখ্য। এক এগারোর সুনামীর পরে আমরা আশা করেছিলাম আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের খাসলতের পরিবর্তন হবে। আমাদের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করবার জন্য তারা এক বছরের বেশি সময় নিলেন না। পুরোনো কায়দায় যোদ্ধাংদেহি মনোভাব নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন পরস্পরের বিরুদ্ধে। সংসদের ভিতরে/বাইরে।
     শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়ার কারণে হোক, প্রবল জনচাপে হোক আর আসন রক্ষার খাতিরেই হোক, দীর্ঘ বর্জনের পর বিএনপি জোটের সংসদে যোগদানকে জাতি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখতে লাগলো। জাতি আশা করলো সংসদ এবার প্রাণবন্ত হবে। কিন্তু বিএনপির যোগদানের পরপরই ট্রেজারী বেঞ্চের বক্তব্যে মনে হলো তারা ঠিক চাইছেন না বিএনপি সংসদে থাকুন। বিএনপি অধিবেশনে যোগ দেবার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যা নিয়ে ৩০০ বিধিতে একটি বিবৃতি দিলেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দিতেই পারেন। যদিও তার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্র আবু বকরের মৃত্যুতে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে বিবৃতি পেলাম না। উপরন্তু বলে বসলেন “এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা হতে পারে!” আমরা মনে করি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন মন্তব্য করতেই পারেন। তিনি তো আর মা  নন। আবু বকরের মৃত্যুতে তার মায়ের বুকে কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে, সেটা আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনোদিনই বুঝতে পারবেন না। সন্তান পেটে ধরলে এবং বকরের মায়ের মত খেয়ে না খেয়ে ছেলেকে লালন-পালন করে বড় করলে তবেই না বুঝতেন সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কত তীব্র! আর সবাই আবু বকরকে নির্দোষ বললেও একটা দোষ কিন্তু তার ঠিকই ছিলো। আর সেটা হলো, সে রাজনীতি করতো না। 
      ৩০০ বিধির অই বিবৃতিতে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় বক্তৃতা শুরু করলেন, তাতে মনে হলো সংসদে নয়, পল্টনে বক্তৃতা করছেন তিনি। তা-ও সরকারের নয়, বিরোধীদলে থেকে! তিনি তার বক্তৃতায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনলেন জিয়াউর রহমানের নাম। খুনি বললেন জিয়াকে। বললেন, হত্যার রাজনীতি শুরু করেছিলো খুনি জিয়া ও মুশতাক। বোধগম্য কারণেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বিএনপি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জিয়াকে খুনি বলার অংশটি এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানায়। স্পীকার মহোদয় সেটা না করায় তারা ওয়াক আউট করে। অবশ্য পরের কার্য দিবসেই আবার ফিরে আসে সংসদে। এসে দাবি জানাতে থাকে আপত্তিকর অই অংশটি এক্সপাঞ্জ করার জন্য। তখন সেই বিতর্কের আগুনে অহেতুক ঘি ঢেলে পরিবেশকে আরো বেশি উত্তপ্ত করে তুলেন মন্ত্রিত্বের পদবঞ্চিত আওয়ামীলীগের এমপি শেখ সেলিম। তিনি বলেন, জিয়ার কবরে জিয়ার লাশ নেই। প্রয়োজনে ডিএনএ টেষ্টেরও দাবি জানান তিনি। তীব্র প্রতিবাদ করে, ফাইল ছুড়ে, গালাগালি ও হট্টগোল করে সংসদ থেকে বেরিয়ে আসে বিএনপি। কিন্তু পরের দিন অধিবেশনে যোগদান করে তারাও শুরু করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য। ‘তুমি অধম হইলেও আমি উত্তম হইবো না কেন’, এই শিক্ষাটুকু আমাদের সম্মানিত এমপি হযরাতগণকে কেউ কখনো দেয়নি। বিএনপি’র সাংসদ সৈয়দা পাপিয়া আশরাফী ও শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন বঙ্গবন্ধুকে। তারা বলেন, ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত ৭০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো। সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয়েছিলো। সুতরাং শেখ মুজিবও খুনি। তারপরে সংসদের অবস্থা আর বর্ণনা না করলেও চলে। কমনওয়েলথ সদস্যরা চেয়ে চেয়ে দেখলেন আমাদের মহান সংসদ সদস্যরা কত বেশি নিচে নামতে পারেন। উপস্থিত সময়ে বাংলা না জানার কারণে কথাবার্তা কোন পর্যায়ে হচ্ছে, বুঝতে না পারলেও পরের দিন ইংরেজি দৈনিকগুলো থেকে তারা বুঝতে পারেন সবকিছু। আর তখন তাদের মনে আমাদের সংসদীয় সংস্কৃতি নিয়ে যে ধারণা তৈরি হবার কথা, জাতি হিসেবে সেটা নিশ্চয় গৌরবের নয়। 
চার \
     প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, “ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়”। জুনিয়ার এমপিরা সিনিয়ারদের কাছ থেকে ভাল কিছু শিখতে আগ্রহী না হলেও মন্দটুকু ঠিকই শিখে নেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জিয়ার মাজারে জিয়ার লাশ আছে কি নেই, জাতীয় সংসদে সেই সংশয় প্রকাশ করার পর সেটাতে লবণ মরিচ মাখিয়ে আরো মুখরোচক করে তুলে ধরলেন শেখ সেলিম। তিনি আরো এক চামচ এগিয়ে গিয়ে চ্যালেঞ্জের সুরে আহ্বান জানালেন ডিএনএ টেষ্টের জন্য। জানিনা আগামীতে আমাদের সবাইকে জন্ম পরিচয়ের গ্যারান্টিপত্র হিসেবে পকেটে করে ডিএনএ সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরতে হবে কিনা! আমাদের এই সংসদে এমন অদ্ভুত কোনো আইন পাশ করা হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দকে আমাদের বড়বেশি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, জিয়ার কবরে লাশ থাকা না থাকার সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশের বা জাতির স্বার্থের কী সম্পর্ক থাকতে পারে আমরা বুঝতে পারছিনা। দয়া করে বলবেন? লাশ থাকুক আর নাই থাকুক, আপনাদের কী আসে যায়? জিয়া অনুসারীরা জিয়ার কবরে ফুল দিচ্ছে, জিয়ারত করছে। আপনাদেরকে তো আর বলছে না আসুন, ফুল দিন। তবে কেন অহেতুক এই টানা হেঁচড়া? জিয়াকে নিয়ে কথা বললে কি বঙ্গবন্ধু অক্ষত থাকেন? থেকেছেন? প্রত্তোত্তরে কি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটাক্য করা হয়নি? টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে কি বিএনপি থেকে কথা উঠেনি? বিএনপি নেতা আ স ম হান্নান শাহ যখন বলেন “পঁচাত্তরে আমি ছিলাম আর্মি অফিসার। ১৫ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ সহ অনেকগুলো লাশ কফিনে ছিলো। কোন্ কফিনে কোন্ লাশ ছিলো অথবা বঙ্গবন্ধুর কবরে যে কফিনটি রাখা হয়েছিলো, সেই কফিনে বঙ্গবন্ধুরই লাশ ছিল কিনা, সংশয়ের অবকাশ রয়েছে...” তখন এর দায় কার! প্রকারান্তরে কি আওয়ামীলীগই দায়ী নয়? জিয়ার লাশ নিয়ে কথা না বললে কি টুঙ্গিপাড়া নিয়ে কথা উঠতো? 
পাঁচ
          কয়েকদিন আগেই এক বক্তব্যে আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বেগম খালেদা জিয়াকে বলেছেন ‘অমানুষ’। সংসদে বিএনপি থেকে যখন অভিযোগ করে বলা হয়, “৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত এদেশের মায়েরা তাদের যুবতী মেয়েদের নিয়ে রাতে ঘুমোতে পারতো না, তখন জবাবে আওয়ামীলীগের এক সাংসদ খালেদা জিয়া সম্বন্ধে যে নোংরা কথাগুলো বলেন, সেটা কোনো সুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে না। সৈয়দ আশরাফের ‘অমানুষ’ থিওরীতে উদ্বুদ্ধ হয়েই কি-না জানিনা, অই এম.পি বললেন, ৭২-৭৫ মধ্যবর্তী সময়ে বেগম খালেদা জিয়াও তো যুবতী ছিলেন। অই সময়ে তিনি যখন রাতে জিয়াউর রহমানের সাথে বিছানায় যেতেন...?” তিনি আরো বলেন, “চারিত্রিক সমস্যার কারণে জিয়াউর রহমান খালেদা জিয়াকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন জিয়াকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সংসার টিকিয়ে দিয়েছিলেন...।” এই হলো আমাদের সাংসদদের সংসদীয় ভাষা! আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন মানসিকতার মানুষকে আমরা ভোট দিয়েছি! তারা আমাদের জন্য আইন তৈরি করবেন! দোষ তো আমাদেরও আছে। এমন অসভ্যতা ও নোংরামী যখন জাতীয় সংসদের প্রদর্শিত হয়, তখন বড়বেশি অসহায় মনে হয় স্পীকারকে। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাতে থাকেন তিনি। তাঁর করার কিছু থাকে না। এই অবস্থায় সংসদে যদি কোনো সংসদ সদস্য অসভ্য ও নোংরা কিছু উচ্চারণ করেন, আর আল্লাহপাকের খাস কুদরতে সংগে সংগেই তার মুখ সেলাই হয়ে যায়, তবেই বন্ধ হতে পারে এই অসুস্থ প্রবণতা। এছাড়া আমি আর কোনো উপায় দেখছি না। 
ছয় \
       বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি। জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক। (হাইকোর্টের রায়কে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি। ঘোষণা তো জিয়া ঠিকই দিয়েছেন, অবশ্য সেটা প্রথম ঘোষণা ছিল কিনা সেটা বলতে পারবেন তখন যারা ছিলেন, তারা)। তুলনামূলক বিশ্লেষণে না গিয়েই আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এই দুই নেতাইতো মহান। বঙ্গবন্ধু থেকে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে কোনো ত্র“টি বিচ্যুতি হয়ে থাকলে সে জন্য যেমন স্বাধীনতার মূল কারিগর হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অবমূলায়ন করা যাবে না, ঠিক তেমনি হাইকোর্ট থেকে ৫ম সংশোধনী বাতিল হলেও, জিয়ার শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করা হলেও একাত্তরে জিয়ার অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আর কোনো শাসনামল অবৈধ হলেও তখনকার সবগুলো কাজ অবৈধ হয়ে যায় না। এই কথাটি মেনে না নিলে আওয়ামীলীগের জন্যই মুশকিল হয়ে যাবে। ২০০৬-০৮ এই দুই বছর ছিলো একটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার। এখন সেই অবৈধ সরকারের সবকাজকে যদি অবৈধ ঘোষণা দেয়া হয়, তাহলে তাদের অধিনে নির্বাচনেরও বৈধতা থাকবে না। আর তাহলে এই সরকারের বৈধতা নিয়াই সংশয় দেখা দেবে।
আওয়ামীলীগ জিয়াকে খুনি বলার পর বিএনপি খুনি বলেছে বঙ্গবন্ধুকে। এর মানে কি আওয়ামীলীগেরই বঙ্গবন্ধুকে খুনি বলা হলো না? আওয়ামীলীগ থেকে জিয়ার কবরে লাশ আছে কি নেই, প্রশ্ন তোলার পর বিএনপি থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে টুঙ্গিপাড়া সম্পর্কে। এর মানে কি বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামীলীগই খাটো করলো না? 
সাত \
        বঙ্গবন্ধু এবং জিয়া, দু’জনেই আমাদের জাতীয় নেতা। আমি দু’জনের মধ্যে কম্পেয়ার করছি না। দেশের জন্য কার কী অবদান, সেটা দেশবাসী জানে। আসল কথা হলো, এই দুই নেতাকে বাদ দিয়ে তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুরুই করা যাবে না। আমরা জানি জীবিত বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়ার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা এবং জীবিত জিয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্নেহ কম ছিল না। আজ তারা কবরে চলে যাওয়ার পর তাদেরকে গালাগালি করেই নিবৃত্ত হচ্ছেন না তারা, তাদের লাশ নিয়ে পর্যন্ত টানা হেঁচড়া শুরু করে দিয়েছেন। আমি বঙ্গবন্ধুর হয়ে আওয়ামীলীগকে এবং শহীদ জিয়ার পক্ষ থেকে বিএনপিকে ধীক্কার জানাই। 
আমরা আশা করতে চাই আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রে সভ্যতার জয় হবে। আমাদের সংসদ সদস্যরা যে কোনো কথা উচ্চারণ করার আগে মনে রাখবেন তারা রেল লাইনের বস্তিতে নয়, জাতীয় সংসদে কথা বলছেন। তারা মনে রাখবেন, দিন যায়, কথা থাকে। তারা মনে রাখবেন চার বছর পর আবার তাদের ফিরে আসতে হবে জনগণের দরজায়। তখন জনগণ যদি তাদেরকে বলে, জনাব গালাগালি করবার জন্য কষ্ট করে আপনার সংসদে যাওয়ার দরকার নেই। এই কাজ বাইরেই সারেন। আর গত ৫ বছরে সংসদে ফালতু কথাবার্তা ও নোংরামি করে কতটাকা খরচ করেছেন, হিসাব দিন। তখন তাদের জবাবটা কী হবে, আমার জানার বড়ই কৌতূহল। 

সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১০

এমন বন্ধু থাকলে শত্র“র দরকার কী



হৃদপিন্ডে যদি পছন ধরে যায়, তাহলে আর রক্ষে নেই। রোগীকে টেকানোই মুশকিল। অবশ্য হায়াত থাকলে এবং সময়মতো বাইপাস সার্জারী করানো গেলে একটু আশা থাকে। হৃদপিন্ড হচ্ছে শরীরের এমন একটি অংশ, যাকে কেটে ফেলেদেবারও সুযোগ নেই। হৃদপিন্ডে পছন বলতে ব্লাড সার্কুলেশনে সমস্যার কথাই বুঝাতে চাইছি আমি। হৃদপিন্ডের কাজ হলো রক্তকে মর্টিফাই করে পরিশুদ্ধ করা, শুদ্ধ রক্তকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়া, নষ্ট রক্তকে বর্জ্য বানিয়ে বা বাষ্প আকারে বের করে দেয়া। হৃদপিন্ডে রক্তের যাতায়াতের রাস্তা হলো দু’টি। একটি হলো ইনলাইন অন্যটি আউটলাইন। ইনলাইন মানে হৃদপিন্ডে রক্ত প্রবেশের রাস্তা আর আউটলাইন মানে বের হবার। কোনো কারণে যদি কোথাও রক্ত চলাচলে বিঘ্র ঘটে, তাহলে রোড ব্লক্ড হয়ে যায়। তখন রোগীর মৃত্যু ঘটে। ডাক্তারদের ভাষায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া। 



মুসলিম জাতিরও একটা হৃদপিন্ড আছে। বিশ্ব মুসলিমের শরীরে রক্তের সার্কুলেশন ঠিকঠাক রাখার কথাছিলো এই হৃদপিন্ডটির। কিন্তু আজকাল সে নিজেই ভোগছে রক্ত শূন্যতায়। একাধিক স্থানে ব্লক্ড্ হয়ে আছে। বাইপাস দরকার। হৃদপিন্ডটির নাম সৌদি আরব। আমাদের এই হৃদপিন্ডে পছনের আলামত দেখা যাচ্ছে। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সহসাই সারিয়ে তোলা না গেলে অস্তিত্বের শেকড়টিকে আমাদের টিকিয়ে রাখাই হবে মুশকিল। বিশ্বনবী সা. হরম শরীফের আঙিনায় ইয়াহুদী-খৃস্টানদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে গেছেন। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইঙ্গ মার্কিন সেনাদেরকে হাফপ্যান্ট পরে পবিত্র সেই আঙিনায় ঘুরে বেড়াতে দেখাগেছে। তা-ও জোর করে নয়, সৌদি কর্তৃপক্ষের দাওয়াতি মেহমান হয়ে! ইরাকে, লেবাননে, আফগানে মুসলিম নিধন চলছে। সৌদি আরব কিছু বলে নি। ফিলিস্তিনি মুসলমানকে সকাল সন্ধ্যা হত্যা করে চলেছে ইজরাঈল। সৌদি আরবের মনে দুঃখ লাগেনি এতটুকুও। আর আজ ... 

মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা মহা পরাক্রমশালী শাসক হযরত উমর রা. হজ্বের সময় হায়্রে আসওয়াদ বা কালো পাথরে চুমো খাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘‘হ্যা-রে পাথর! তোর যে চেহারা, তাতে তোকে তো চুমো খাওয়ার প্রশ্নই আসতো না। আমি আমার নবীকে দেখেছি তোকে চুমো খেতে, তাই আমি তোকে চুমো খাচ্ছি। ভাবিস না তোর রূপে মুগ্ধ হয়ে বা তোর প্রতি ভালবাসায় আমি এ কাজ করছি’’। সৌদি আরবের নিকটঅতীত ও সা¤প্রতিক কান্ড-কারখানাকে সামনে রাখলে আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করবে, হ্যা-রে আরব! তোর বুকে আমার ক্বিবলাটি, পবিত্র কা’বা ঘরটি রয়েছে বলে আমি তোকে সম্মান করি। দেড়হাজার বছর আগে আমাদের একজন প্রিয় মানুষ, সব'চে প্রিয় মানুষ তোর কোলে এসেছিলেন বলে তুই আমাদের প্রিয়। তোর মাটিতে আমাদের সেই ভালবাসার মানুষটি শুয়ে আছেন বলে আমরা তোর মাটিকে ভালবাসি। তা না হলে তোর যে খাসলত, তাতে তোকে ভালবাসা দূরে থাক, ঘৃণাই করতাম না আমরা। একজনের সাথে অন্যজনের সম্পর্ক হতে পারে দু’ধরনের, (১) ভালবাসার সম্পর্ক (২) ঘৃণার সম্পর্ক। তোকে ঘৃনা করলেও তো একটা সম্পর্ক সাবিত হতো। আমরা সেটাও চাইতাম না। কিন্তু কী করবো। তোর সৌভাগ্য যে, কা’বা ঘর এবং বিশ্বনবীর রওজাহ তোর বুকে। আর এটাই আমাদের দুর্বলতা। আমাদের মজবুরী। 

দুই

. ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের অবৈধ মিলনে জন্ম নেয়া জারজ একটি রাষ্ট্র হলো ইজরাঈল। ইজরাঈল কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কি কি? ইয়াসির আরাফাত ভাল বলতে পারতেন। হাড়ে হাড়ে ঠের পেয়েছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনের সেই ছোট্ট শিশুটি, সবেমাত্র কথা বলতে শিখেছে যে, জিজ্ঞেস করুন তাকে, ইজরাঈল সম্বন্ধে। চোখ-মুখ সাদা করে ভয়ে আত্কে উঠবে সে-ও। স্বামী-সন্তান হারানো ফিলিস্তিনের কোনো বিধবা বোনকে আমার প্রশ্ন করুন, ইজরাঈল ও আজরাঈলের মধ্যে কাকে বেশি ভয় করে সে? জবাবে ইজরাঈলের কথাই বলবে। এর কারণ, সে জানে, আজরাঈল কাজ করেন ইন্সাফের মানদন্ডে। কষ্ট তিনি শুধু পাপীদেরই দেন। আর ইজরাঈল সামনে যাকে পায়, তাকেই মারে। পাপ পূণ্য বুঝেনা, শিশু বুড়ো দেখে না। শুধু দেখে লোকটি মুসলমান কি না! প্রথম প্রথম ইজরাঈল ছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদি একটি গ্র“প। আস্তিনের ভেতরের শাপের মতো। সেই আস্তিনটি ছিলো বুড়ো শয়তানের। অস্তিত্বের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তখন তারা রক্তপাত ঘটাতো। ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তারা ছিলো হিংস্র পশুর ভূমিকায়। বিশ্বের বড়মোড়ল ছিলো সাথে। নেপথ্যে থেকে ইন্দন যোগাতো। আর এখন সেই ইজরাঈল রীতিমতো ঢাকঢুল পিটিয়ে সাম্রাজ্যবাদি আগ্রাসি মনোভাব নিয়ে সামনে এগুতে চাইছে, কারণ, বড় শয়তান এখন আর নেপথ্যে থেকে নয়, পাশে থেকেই সাহস যোগাচ্ছে। 

বর্তমান বিশ্বের ভয়ংকর প্রভাবশালী কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে একটি হলো ইজরাঈলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে তারা ইজিলি প্যাঁচ লাগিয়ে দিতে পারে। তারা আজ এতটাই ক্ষমতাশালী ও সামর্থবান যে, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো পরিবেশে যে কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। অতি স¤প্রতি তারা সেটার প্রমাণও দিয়েছে। মোসাদের পাক্কা ইনফরমেশন ও প্লান অনুযায়ী ইজরাঈলি ক্যাডাররা দুবাই শহরে ঢুকে হামাস’র এক শীর্ষ নেতাকে হত্যা করে নির্বিঘেœ আবার স্বদেশে ফিরে যেতেও সক্ষম হয়। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হচ্ছে এমন, হামাস নেতা মাহমুদ আল মাবহু দুবাই শহরের একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন। যে সংবাদ ফিলিস্তিনিরাও জানতো না। মোসাদের মাধ্যমে ইজরাঈলিরা সেটা খুঁজে বের করে। তারপর ১২ জন ইজরাঈলির একটি গ্র“প জাল ব্রিটিশ পাসপোর্ট তৈরি করে। আর এই জাল পাসপোর্ট তৈরিতে তাদের সহায়তা করেন ব্রিটেনে নিযুক্ত একজন ইজরাঈলি কুটনীতিক। যাকে স¤প্রতি ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করেছে। ১২ জনের সেই দলটি ভুঁয়া ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে সকলের চোখ ফাকি দিয়ে প্রবশে করে সেই হোটেলে। হামাস নেতা মাহমুদ আল মাবহু কে হত্যা করে সহি সালামতে আবার তারা তাদের দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হয়। 

তিন

. অতি স¤প্রতি সৌদি আরব একটি ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ইরানে হামলা চালানোর জন্য ইজরাঈলকে সৌদিআরবের আকাশসীমা ব্যবহারের সুযোগ দিতে রাজি হয়েছে। গত ১২ জুন দ্য লন্ডন টাইমস্ সূত্রে জানাগেছে এ সংবাদ। ইরান পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করছে বলে জাতিসংঘের মাইক্রোফোনে যুক্তরাষ্ট্র বেশ আগে থেকেই হামকে-তুমকে করছিলো। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নামের একচোখা সংস্থাটি একটার পর একটা অবরোধের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছিলো ইরানের ঘাড়ে।সম্প্রপ্রতি চতুর্থ দফা অবরোধের ঘোষণা দেয়ার পরপরই এই সংবাদ প্রকাশ পায়। জানাযায় সৌদি সরকার ইরানে হামলার জন্য তাদের আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেবে। ইজরাঈলি বোমারু বিমান সৌদি সীমান্তে প্রবেশ করলে সৌদি সেটা দেখেও দেখবে না। সৌদি সেনাবাহিনীকে সেভাবেই বার্তা পৌছে দেয়া হয়েছে। ইরানের যে স্থানে পারমানবিক স্থাপনা রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, ইজরাঈল থেকে সেখানকার দূরত্ব ১ হাজার ৪শ মাইল। ইজরাঈলি জঙ্গি বিমান আকাশে রিফুয়েলিং করলেও এই দূরত্ব অতিক্রম করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। আমাদের সৌদি সরকার ইজরাঈলের এই মুশকিল আসান করে দিয়েছে। 

সৌদি সরকার সিদ্ধান্তটি যে হুট করে নেয় নি, সেটা টাইমস’র রিপোর্ট থেকেই জানাগেছে। ইজরাঈলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু অনেক আগে থেকেই ইরানে সামরিক হামলার হুমকি দিয়ে আসছিলেন। নেতানিয়াহুর পূর্বসুরী এহুদ ওলমার্ট ইরান প্রসঙ্গে সৌদি সরকারের সাথে একাধিক গোপন বৈঠক করেছেন। ২০০৯ সালে ইজরাঈলের গোয়েন্দা বিভাগ ‘মোসাদ’ এর প্রধান মায়ার দাগানও সৌদি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে ইরান আক্রমনের জন্য সৌদির আকাশসীমা ব্যবহারের ব্যাপারে ফলপ্রসু আলোচনা হয় বলে জানা যায়। দফায় দফায় অনুষ্ঠিত সেই গোপন বৈঠকগুলোর সূত্র ধরেই অতি স¤প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সাথে সৌদি আরব একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুসারে সৌদি সরকার ইজরাঈলি জঙ্গি বিমানকে ইরানে হামলা চালাতে নিজ আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দিতে রাজি হয়। 

চার.

সৌদি আরবের চোখে পশ্চিমা পর্দা পড়ে যাওয়ায় তারা হয়তো দেখতে পায়নি কিন্তু বিশ্ববাসী তো দেখেছে, গত মে মাসে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাগামী তুরস্কের ত্রাণবাহি জাহাজে কিভাবে বর্বর হামলা চালিয়েছিলো এই ইজরাঈল। কিভাবে ১৯ জন নিরীহ ত্রাণ কর্মীকে হত্যা করে জাহাজটি ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। সৌদি আরব ভুলে গেলেও বিশ্ব মুসলিম কিন্তু ভুলে যায়নি এই ইহুদীরাই আরবের মাটি থেকে নবীজির লাশটি চুরি করতে চেয়েছিলো। সেই ইহুদী, সেই ইজরাঈলের প্রতি সৌদি আরবের প্রেম উত্লে উঠার কী কারণ থাকতে পারে, আমার বুঝে আসেনা। যদি বলা হয় ইরান পারমানবিক শক্তিধর হলে সেটা সৌদি আরবের জন্যও হুমকি, সৌদি যদি এটাই মনে করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে হৃদপিন্ডের সাথে সাথে তাদের ব্রেইনও ডেমেজ হয়ে গেছে। মুসলিম কোনো দেশ শক্তিশালী হলে তো আতংকিত হবার কথা অমুসলিমদের। সৌদি আরব ভয় পাবে কেন? নাকি কাফেরদের সাথে দহরম মহরম করতে করতে তারা নিজেদেরকেও ওদের কাতারে গণ্য করতে শুরু করেছে? আল্লাই জানে। ঈমান-আকীদার প্রশ্নে অভ্যন্তরীন অবস্থা যাই হোক, ইরান একটি ইসলামী রাষ্ট্র। জাতিসংঘ হোক, আমেরিকা হোক বা ইজরাঈল, তারা শিয়া-সুন্নি বুঝে না, আকীদার ধার ধারেনা। তারা শুধু দেখে দেশটি মুসলিম কি না? আর একটি মুসলিম দেশে হামলা চালানোর জন্য নিজের বুকের উপর দিয়ে রাস্তা করে দেয়ার আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত যখন নেয় আরেকটি মুসলিম রাষ্ট্র, তখন কপাল থাপড়ানো ছাড়া আর কী করার থাকে? 

আমি জানিনা ইরান সত্যি সত্যিই পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলেছে কি না! যদি করে থাকে, তাহলে সেটা দেখবে জাতিসংঘ। ইজরাঈল নয়। আর এ ব্যাপারে জাতিসংঘকে পদক্ষেপ নেয়ার আগে নিশ্চিত করতে হবে নিরাপত্তা পরিষদের ৫ সদস্য রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো দেশের কাছেও অবৈধ অস্ত্র নেই। ইজরাঈলের কাছে পারমানবিক অস্ত্র থাকা হালাল হলে ইরানের জন্য হারাম হবে কেন? ইজরাঈলের ভান্ডারে মানবতা বিরুধী গোলাবারুদের পাহাড় জমে থাকবে, তারা তাফালিং করবে ইচ্ছে মতো, মারবে যাকে খুশি, আর মুসলিম দেশগুলো বসে বসে শুধু মার যাওয়ার অপেক্ষা করবে, তা তো হতে পারে না। কিন্তু আফসোসের কথা হলো, এই সত্য কথাটি সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করার মতো একজন লোকও নেই। 

একসময় আমরা দেখলাম ইরাকে অবৈধ অস্ত্রের কারখানা রয়েছে অজুহাতে হামলা চালানো হলো ইরাকে। মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হলো মুসলিম এই দেশটিকে। সাদ্দামকে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ঝুলিয়ে দেয়া হলো ফাসিতে। বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দ থেকে কেউ একজনও আজ পর্যন্ত জাতিসংঘকে জিজ্ঞেস করতে পারলেন না আজ অব্দি ইরাকে কি অবৈধ অস্ত্রের স্থাপনা পাওয়া গেছে? তাহলে কেন ছিল সেই বর্বরতা? মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ ভাবে একটি হুংকার দিতে পারতো, যদি শুধু বলতো, কোনো মুসলিম রাষ্ট্রকে অন্যায়ভাবে আক্রমন করা যাবে না, তাহলে আমরা আমাদের তেল বন্ধ করে দেবো, অমুসলিম কোনো রাষ্ট্রকে তেল দেবো না: তাহলেই তাদের তেলতেলি কমে যেতো। একটি দিন মাত্র তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিলে পাগলা কুকুরের মতো লেজ ফেলে সোজা হয়ে যেতো ওরা। কিন্তু আমি জানি, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো সেটা করবে না। তাদেরকে করতে দেয়া হবে না। একটা একটা করে মুসলিম রাষ্ট্র ধরা হবে। প্রথমে ধরা হবে সেগুলোকে, যেগুলোর মেরুদন্ড একটু মজবুত। ইরাকের মেরুদন্ড মজবুত ছিলো, ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মাধ্যম বানানো হয়েছে কুয়েতকে। ইরানকে মারতে ব্যবহার করা হবে সৌদি আরবকে। গাদ্দাফীর লিবিয়াতো অনেক আগেই গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে। পাকিস্তানকে পাকিস্তানিদের দ্বারাই সাইজ করা হচ্ছে। বাদবাকী মেরুদন্ডহীন মুসলিম দেশগুলো নিয়ে তাদের তেমন একটা মাথা ব্যাথা নেই। 

মুসলমান মুসলমানের ভাই। ভাই’র শরীরে আঘাত পড়লে অন্য ভাই’র কষ্ট পাবার কথা। মুসলমান মুসলমানের বন্ধু। বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। সৌদি আরব হলো মুসলিম বিশ্বের সবচে কাছের বন্ধু। কিন্তু সৌদির সা¤প্রতিক কান্ডকীর্তিকে সামনে রাখলে বলতেই হবে, এমন বন্ধু থাকলে আর শত্র“র কোনো দরকার নেই। বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমানের পক্ষ থেকে আমরা সৌদি আরবের প্রতি তীব্র ক্ষোভ, ঘৃনা ও ধিক্ষার জানাই। সেই সঙ্গে তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়ার কামনা করি।

অসুস্থ কলম, আক্রান্ত জাতি ...সুবিধাবাদী লেখক এবং বোবা শয়তানের গল্প

তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে উঠার অংকটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু তৈলাক্ত কলমের কথা অনেকেই জানি না। জানা দরকার। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে পারার জন্য এটা জানা জরুরী। একটি কলমের ক্ষমতা অনেক। একটি তরবারীর ক্ষমতাও কম না। অনেক রাজ্য জয় করেছে তরবারী। কিন্তু আমরা কি জানি সেই উন্মুক্ত তরবারীগুলোর চালকের রক্তে উষ্ণতা তৈরি করার আসল কাজটি কিন্তু কলমই করেছে। তবে তরবারী ও কলম, দু'টোর মাঝে পার্থক্য আছে। তরবারীর আঘাতে লাল রং বেরোয়। কলমের আঘাতে বেরোয় কালো। তরবারীর রং বেরোয় ধ্বংস করার জন্য। কলমের কালো নূতন কিছু সৃষ্টি করে। কলম স্বপ্ন দেখায়, তরবারী স্বপ্নের জগতে গিয়ে হানা দেয়। সবমিলিয়ে বলা যায় একটি কলমের ক্ষমতা অনেক। ইস্পাতের সামান্য একটি তরবারীর’চে তো অবশ্যই বেশি। এত ক্ষমতাবান একটি কলম যাদের রয়েছে, তাদের নাম লেখক। ইংরেজি Author। আজ আমরা লেখকদের গল্প করবো।
¬¬ প্রাইমারী লেবেলের ছোট্ট কোনো বন্ধু যদি এই মুহুর্তের পাঠক হয়, তাহলে তার জন্য জানিয়ে রাখি। ইংরেজি Writer এবং Author দু'টোর বাংলাই লেখক। তবে পার্থক্য আছে। কলম হাতে নিয়ে সাদা কাগজে যে কোনো কিছু লিখলেই তাকে Writer অর্থে লেখক বলা যাবে। যেমনDid writer বা দলিল লেখক। Type writer বা টাইপ মেশিনে লেখক। এমনকি যারা পরীক্ষার খাতা লেখে, মামলার এফআইআর লেখে, দোকানের জমাÑখরচ লেখে, ক্রিকেট খেলার স্কোর লেখে, রেষ্টুরেন্টের বিল লেখে, রাইটার অর্থে তারাও লেখক। তবে আমাদের সমাজে আমরা যাদের লেখক বলি, অর্থাৎ যাদের লেখা আমরা আগ্রহ নিয়ে পড়ি, আনন্দের কিছু পেলে দাঁত ফাঁক করে হাসি, কষ্টের কথায় হাÑহুতাশ করি, অর্থাৎ যারা গল্প, কবিতা, উপন্যাস লেখেন, পত্রিকায় ফিচার লেখেন, সাবজেক্টিভ বই-কিতাব লেখেন, এক কথায় যাদের লেখার মূল হলো Creative faculty সেই লেখকরা কিন্তু Writer না। তারা হলেনAuthor।
একজন লেখকের ক্ষমতা অনেক। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে ওলট-পালট করে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে একজন লেখকের কলমের। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের উপস্থিতি ছিলো ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে। নজরুল অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন নি। করেছেন কলম হাতে। “লাথি মার ভাঙ্রে তালা, যত সব বন্দিশালা আগুন জ্বালা...” কবিতাগুলো থেকে যে গোলাবারুদ বের হতো, সেটা এ.কে ৪৭ রাইফেলেরচে কোনো অংশেই কম ছিলো না। যুদ্ধবাজ, জুলুমবাজ, আধিপাত্যবাদী গোষ্ঠী, সকল যুগের, অস্ত্রের’চে কলমকেই ভয় করেছে বেশি। ৪৭ পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা তাদের জন্য অন্যতম হুমকী হিসিবে চিহ্নিত করেছিলো মাওলানা আবুল কালাম আযাদের কলমকে। তাঁকে জেলে পুরেও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি তারা। পাহারাদার রাখা হয়েছিলো যাতে তাঁর কলমটি গর্জে উঠতে না পারে। আজও কলমকে নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে বলে গোঠা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রন করছে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র।
দুই.
একজন লেখকের সুবিধা, অসুবিধা এবং বে-সুবিধা, তিন দিকই আছে। সুবিধাবাদী লেখকদের কথা জানতে হলে প্রথমে এগুলো জানা দরকার। বেসুবিধা শব্দটি যাদের খট্কায় ফেলে দিয়েছে, তাদের জন্য বলি। বাংলা ব্যাকরণে এই শব্দটির প্রয়োজন আছে। অন্তত আমি আমার জীবনে সেটার উপস্থিতি ঠের পেয়েছি।
লেখকের সুবিধা হচ্ছে, মনের কথা সময় নিয়ে গুছিয়ে বলতে পারেন। মনের ঈশানে জমে থাকা কালো মেঘগুলো নিরবে বসে বের করে দিয়ে হালকা হতে পারেন। লেখকের সবচে’ বড় সুবিধা হল তারা স্বপ্ন দেখতে পারেন। পারেন স্বপ্ন দেখাতেও । বর্তমানে বসে ভবিষ্যতের বেলকনিতে চলে যেতে পারেন স্বপ্নের হাতধরে। পাঠককেও নিয়ে যেতে পারেন সেখানে।
লেখকের অসুবিধার শেষ নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে একজন লেখকের প্রথম পছন্দ, প্রথম প্রাপ্য। অন্যের অধিকারে বা অনুভূতিতে আঘাত না করে স্বাধীনভাবে লিখতে পারার সুযোগ থাকা উচিৎ একজন লেখকের। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা কী দেখি? মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধু কিতাবেই আছে। বাস্তবে নেই। কথা বলতে হয় মেপে মেপে। পরিবেশ-পরস্থিতি ওজন করে। রাষ্ট্রীয় হর্তাকর্তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলার আগে সম্ভাব্য সকল প্রকার ঝুঁকির আশংকা মাথায় রাখতে হয়। আমার দেশের কর্তাব্যক্তিরা ভিন্নমত হজম করে অব্যস্ত না। তাদের পছন্দ তোষামোদ। দ্বীনি কোনো মাসআ’লা নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা জাগলে মাথায় রাখতে হয় বুযুর্গানে দ্বীনের মখ্তলিফ্ নযরিয়্যাতের বিষয়টিও। লেখকের অন্যতম আরেকটি অসুবিধা হল ক্ষেত্র সংকট। লেখা প্রকাশের পরিধি সংকট। একজন নবীন লেখক, অসম্ভব প্রতিভা রয়েছে তার। সে সেটাকে খুব বেশিদিন লালন করতে পারছে না। প্রথম কারণ, পরিচর্যা পাচ্ছে না। দ্বিতীয় কারণ, বিকশিত হওয়ার জায়গা ও সুযোগ পাচ্ছে না।
সুবিধা অর্থ সহজ উপায়। উপায় যদি সহজ না হয়ে একটু কঠিন হয়, তাহলে তার নাম অসুবিধা। আর উপায়টি যদি হয় ঝুঁকিপূর্ণ, আশংকাজনক, তাহলে সেটাকে তো অসুবিধা বলে হালকা করে দেখা যাবে না। তাহলে কী বলবেন? আমি এর নাম দিলাম বেসুবিধা। বেসুবিধার উদাহরণ দিচ্ছি? দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তনয় জয় এবং জ্বালানী উপদেষ্টা তৌফিক এলাহির বিরুদ্ধে পেট্রোবাংলা থেকে উঠানো দূর্নীতির অভিযোগের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো। যার রির্পোটার বা লেখক ছিলেন পত্রিকাটির সিনিয়ার সাংবাদিক মোঃ আব্দুল্লাহ। প্রতিবেদনটি লেখার কারণে তার উপর সন্ত্রাসী হামলা হলো। ফেনীর একসময়ের দাপুটে আওয়ামীলীগ নেতা জয়নাল হাজারীর ষ্টিয়ারিং কমিটি সাংবাদিক টিপুর পা ভেঙে দিয়েছিলো। এগুলোকে কী বলবেন? বেসুবিধা না বলে উপায় আছে?
বেসুবিধার আরেকটি উদাহরণ দিই। কেউ অন্যভাবে নেবে না। ভাববেন না নিজেকে আমি লেখক হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছি। বিনয় নয়, বাস্তবিক অর্থেই এখনো আমি সাহিত্যের দন্ত্য-স এর ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছি। বানানরীতি, মাত্রা জ্ঞান, গদ্যের ছন্দ, ভাবের সাথে বাক্যের তাল, উপস্থাপনের সাবলিলতা ইত্যাদি এখনো আয়ত্বে আনা হয় নি। এগুলো ঠিকমত জানা হলে তবেই না শব্দের সাঁকো তৈরি করবো, যে সাঁকো দিয়ে পার হবে কালের কলিরা। সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যাবে সময়। গিয়ে মিশে যাবে আবার সময়ের সাথে। সাথে থাকবে শুদ্ধির মিছিল। আগে আমাকে এগুলো জানতে হবে। মানতে হবে। তবেই না লেখক। তার আগে লেখালেখি শুরু করলে ঝামেলা আছে। শারীরিক আঘাত আসুক বা না-ই আসুক, মানসিক টর্চার আসবেই। এসেছে আমার উপরও। ঠুঁট কাটা কিছু রূঢ় কথা লিখে ফেলেছিলাম বলে কোনো এক সময় কম তিরস্কৃত হতে হয়নি আমাকে। এরচে বেশি আর কিছু বলতে চাই না। পানিতে কুপ মারতে চাই না, হাটুতো নিজেরই।
তিন.
লেখালেখি চার প্রকারের হতে পারে বলেই আমার ধারনা।
(১) স্রোতের অনুকূলে
(২) স্রোতের প্রতিকূলে
(৩) গতানুগতিক
(৪) বাস্তবকেন্দ্রিক।
স্রোতের প্রতিকূলে বুক চিত্রে দাঁড়িয়ে যারা লিখে যেতে পারেন, তাদের অন্য নাম বিদ্রোহী লেখক। স্রোতের অনুকূলে কলম ভাসিয়ে দিলে তাদের নাম হয় সুবিধাবাদী লেখক। এ ধরনের লেখকের লেখার অপর নাম তেল মারা। কোনো কিছুর চিন্তা বা তোয়াক্কা না করে যা সত্য, যা বিবেকসিদ্ধ, যা বাস্তব, তাই লিখে যাওয়ার নাম বাস্তবকেন্দ্রিক লেখা। আর সবগুলোর দরমিয়ানী রাস্তা এখতিয়ার করে লিখলে সেটা হয় গতানুগতিক লেখা। আমার পর্যবেক্ষণ ও শ্রেণী বিন্যাস ভুলও হতে পারে। বিশ্বাস করতে হবে এমনও কোনো কথা নেই। আমি আমার কথা বললাম। গতানুগতিক লেখকদের উদাহরণ দেয়া হয় নি। দু’টি উদাহরণ দিচ্ছি। আলেম লেখকদের জন্য একটা। গায়রে আলেম সাধারণ লেখকদের জন্য একটা।
আলেম লেখকদের ম্যাক্সিমামই যে কোনো ধর্মীয় বিষয়ের গুরুত্ব, ফজিলত, তাৎপর্য ও আহম্মিয়তের বর্ণনা নির্ভর লেখালেখিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ওসব বিষয়ে খত্রা নেই। কিন্তু যে কোনো সরকার দ্বীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে সে বিষয়ে তাদের কলম নিরবতা পালন করাকেই নিরাপদ মনে করে। তাঁরা এবাদত নির্ভর বিষয়াদি নিয়ে লিখে লিখে বিরাট পুস্তক তৈরি করে ফেলেন কিন্তু শরয়ী আহকামাত, মুনকারাত এবং স্পর্শকাতর হক্ক কথা তাদের আর লেখা হয় না। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা আকরম খা, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, কবি ফররুখ, নজরুল, এই নামগুলো হারিয়ে গেছে তাদের মনতশির জেহেন থেকে!
গায়রে আলেম লেখকদের মধ্যে সুবিধাবাদী লেখকদের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। সময়ের নাজুকতা থাকে তাদের নখদপর্নে। স্রোতের অনুকূলেই চলে তাদের কলম। এরা হয় পরজীবি প্রকৃতির। এরা হয় ককুর স্বভাবী। হাড়ের জন্য লেখে। মাড়ের জন্য লেখে। হাড় এবং মাড় পেলে তাদের পক্ষে যে কোনো কিছুই লেখা সম্ভব। তাদের কোনো সমস্যা হয় না কারণ, বিবেক বলে কোনো বস্তু তাদের এক’শ হাতের ভেতরে এসে ঢুকতে পারে না। এরা হচ্ছে অতি নিম্নমানের জঘন্য রুচির সুবিধাবাদী লেখক। সুবিধাবাদী লেখকের আরো একটি গ্র“প আছে। এরা মূলত হাড় আর মাড়ের জন্য লেখে না। তবে তারা অসম্ভব প্রকৃতির ভীতূ। ভীতূর ডিমে বসে তারা তা দেয়। তাদের তলানীতে কিছু বিবেকও আছে। সেই বিবেকের মুখে থাকে স্লাইডিং দরজা। যে দরজা ধাক্কা দিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে সরানো যায়। সময় বুঝে তারা তাদের বিবেকের দরজাকে এদিক-উদিক করে। অবস্থা সুবিধার না হলে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরা তখন হয়ে যায় বোবা শয়তান। যে সত্য না বলে চুপ থাকে, তাকে বলা হয় বোবা শয়তান, আরবীতে আখ্রস শয়তান। শায়তানুন আখ্রাসুন। আর যদি লিখেও কিছু, সেটা হয় জ্বী হুজুর টাইপ। অবিকল মানুষের মত দেখতে এই প্রাণীগুলো সাপের মত মেরুদন্ডহীন। এরা সত্য বলে না, সত্য বুঝে না, সত্য দেখে না। এরা চতুস্পদ জন্তুরচে’ও নিকৃষ্ট। এই বিশেষন আমি দিচ্ছি না। দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক...“তাদের অন্তর আছে কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু চোখ দিয়ে দেখতে চায় না, তাদের কানও আছে কিন্তু শুনতে চায় না। এরা চারপায়ী জন্তুর মত, বরং তারচেও নিকৃষ্ট।” সুতরাং বিবেককে কাজে লাগিয়ে যে লেখক লিখবেন না, বা লেখা থেকে বিরত থাকবেন, তাদের বিশেষন দৃ’টি। যার যেটা পছন্দ, গ্রহণ করতে পারেন।
(১) চতুস্পদ জন্তু
(২) বোবা শয়তান।
চার.
সুবিধাবাদী লেখক সকল পর্যায়েই আছেন। আমার ঔদ্ধত্ব ক্ষমা করা হলে আমি বলবো আলেম লেখকদের মধ্যেও এই সংখ্যা নেহায়ত কম না। কোনো না কোনো ইসলামী রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা থাকলে তার চোখে এক ধরনের পর্দা পড়ে যায়। কুরআনের ভাষায় যাকে বলা যায় গিশাওয়াহ্। তখন আর নিজ দলের দুর্বলতা লেখক মহোদয়ের চোখে পড়ে না। তাঁর রাজনৈতিক মুরব্বীদের মুখ থেকে কোনো ভুল কথা উচ্চারিত হলেও তিনি এক’শ একটা যুক্তি খাড়া করে প্রমাণ করতে চাইবেন এরচে খাঁটি কোনো বাণী আল্লাহর জমীনে এর আগে আর কেউ দেন নি! অই সকল রাজনৈতিক দলের বসন্তবাদী লেখকরা ভুলেও খুঁজে দেখেন না ইসলামী রাজনীতির পহেলা নাম্বার শর্ত খুলুসিয়্যাত ও লিল্যাহিয়্যাত তাদের সংগঠনে আছে কি না! থাকলে দেখা যাচ্ছেনা কেন? না থাকলে নেই কেন? অই লেখকরা তাদের আলেম নেতার সামনে প্রয়োজনে নতজানু হয়েও জিজ্ঞেস করেন না, ঐক্য তাদের এতবেশি অপছন্দের জিনিষ কেন?
সাধারণ সুবিধাবাদী লেখকদের সবচে বেশি পরিচয় আমরা পেয়েছি গত তিন উদ্দিনের সরকারের সময়ে। আই.এম.এফ বা ইয়াজুদ্দিন, মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দিন এর আমলে আমরা দেখেছি সুবিধাবাদ কাহাকে বলে? উহা কত প্রকার ও কী কী? দেশের নামি দামি লেখকরা হাটুগালা দিয়ে শুরু করেছিলেন অই সরকারের স্তুতি ও স্থাবকতা। ট্রিপল উদ্দিনের সরকারকে মোটামুটি ফেরেশতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে রীতিমত বন্দনায় মেতে উঠেছিলেন তারা। প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন কে কত বেশি হাসিনাÑখালেদা বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরে সেই সরকারের নেক নজর কাড়তে পারেন।
সময় পাল্টে গেছে। সুবিধাবাদী অই লেখকরাও খোলস পাল্টে ফেলেছেন। যে দুই নেত্রীকে তাদের লেখায় প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সকল সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু এবং গণতন্ত্রের দুশমন, তাদেরকেই এখন আবার ব্যাখ্যা করছেন গণতন্ত্রের ক্যাপসুল হিসেবে। ভাবখানা এমন যে, এই দুই নেত্রীই গণতন্ত্রের দুর্ঘটনা কবলিত গাড়িটিকে খাদের কিনারা থেকে তুলে এনে জং ধরা ইঞ্জিনটি সার্ভিসিং করে সচল করে তুলেছেন। জাতিকে এ জন্য কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে দুই নেত্রীকে কুর্নিশ করা দরকার। এমন লেখকদের চিহ্নিত করে রাখা প্রয়োজন। জাতির জন্য এরা এক ধরনের হুমকি। সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য পাপ এরা।
পাঁচ. বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে নাস্তিকতাকে প্রগতির সমার্থক শব্দ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। যেন নাস্তিক বা তার কাছাকাছি যেতে না পারলে প্রগতিশীল লেখক হওয়া যাবে না! প্রগতির ঠিকাদার সেজে রাজধানীতে বসে যারা হাম্কে-তুম্কে করেন, তারা সংখ্যায় খুব কম তবে প্রভাবশালী। নাস্তিকতাকে মাপকাটি বানিয়েই তারা লেখার ভালমন্দ গুণাগুন বিচার করেন তবে তাদের অনেকেই নিজেকে নাস্তিক বলে প্রকাশ করেন না। বলার আর অপেক্ষা রাখেনা যে, কোনো সরকারের মাথায় ইসলাম বিদ্বেষের পোকা ঢুকিয়ে দেয়াই তাদের আসল কাজ। এই কাজটি না করলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না।
বাংলাদেশে আরো কিছু লেখক আছেন যারা ফেরাউন স্বভাবী। ফেরাউনের নীতিতে বিশ্বাসী। কথাটি ব্যাখ্যা করছি। তার আগে আরো কিছু কথা জেনে নেয়া দরকার। আমাদের সমাজে কিছু লেখক আছেন, যারা নাস্তিক তো নন, তবে নিজের ধর্ম বিশ্বাস প্রকাশ করতে কুন্ঠাবোধ করেন। পাছে না আবার প্রগতির গায়ে দাগ লেগে যায়, এই ভয়ে। আমার মনে পড়ছে দেশের জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিককে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, “আপনি কি আস্তিক?” ক্রিকেটের বাউন্সার থেকে গা বাঁচানোর মত করে সু-কৌশলে জবাব এড়িয়ে গেলেন তিনি। বললেন, “বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।” কিছু লেখক আছেন যারা বৎসরে দুই ঈদের নামাজে হাজির হন। এই অর্থে তারা আল্লাহ বিশ্বাসী। কিন্তু তারা তাদের লেখালেখিতে আল্লাহ শব্দটি উচ্চারণ করেন না? তারা বলেন ঈশ্বর!
এবার ফেরাউন স্বভাবীদের কথা বলি। ফেরাউন আস্তিক ছিলো না নাস্তিকও ছিলো না। সে ছিলো সস্তিক(!)। সস্তিক শব্দটি উৎপাদন করা হলো। স্রষ্টায় বিশ্বাসী হলে আস্তিক। না হলে নাস্তিক। কিন্তু নিজেকেই স্রষ্টা দাবি করলে তার জন্য কোনো না কোনো শব্দতো লাগবেই। সস্তিক শব্দটি আমার কাছে মন্দ মনে হয় নি। তো ফেরাউন নিজেকেই খোদা বলে দাবি করতো। তাও যেন-তেন খোদা না, সবচে’ বড় খোদা। যদিও সেও জানতো, সত্যিকারের আল্লাহ একজন ঠিকই আছেন। তবে প্রকাশ করতো না। কিন্তু কথায় আছে না, সাপ গর্তে ঢুকে সোজা হয়ে। ফেরাউনও গর্তে ঢোকার সময় সোজা হতে চেয়েছিলো। ঈমান আনতে চেয়েছিলো আল্লাহর উপর। সুযোগ দেয়া হয় নি। আমাদের দেশের ফেরাউন স্বভাবী লেখকরাও বয়স হয়েগেলে সুর নরম করে ফেলেন। ধীরে ধীরে যখন এগিয়ে চলেন বার্ধক্যের অন্ধকার সরু গলির পথ ধরে, তখন মৃত্যুর ভয় তাদের কাবু করে ফেলে। তখন খোদাদ্রোহী প্রগতির ভাঙ্গা রেকর্ড আর বাজান না। এমনকি তখন তাদের অনেককে নামাজ রোযার দিকে বিশেষ নজর দিতেও দেখা যায়। প্রয়াত লেখক, ড. হুমায়ুন আজাদের মত স্বঘোষিত নাস্তিক লোকেরও পাশে বসে তার মেয়েকে আমরা সুরায়ে ইয়াসিন তেলাওয়াত করতে দেখেছি। জানাযাও হয়েছে যথারীতি।
ছয়.
আমাদের দেশে বেশ ওজনদার লেখক আছেন কিছু। যারা লিখনে আচরণে যাই হোন, নামটি তাদের ইসলামী। মা বাবার দেয়া মুসলমান নামটি আর পরিবর্তন করেন নি। তবে ইসলাম শব্দটি থেকেই গুনে গুনে একশ হাত দূরে থাকতে চেষ্টা করেন। তাদেরকে কিন্তু নাস্তিক লেখক বলা যাবে না। কেউ আল্লাহ বিশ্বাস না করলেও, খোদাদ্রোহী কথাবার্তা বললেও, তাকে আর যা-ই বলা যাক, নাস্তিক বলা যায় না। নাস্তিক অই ব্যক্তিকেই বলা যাবে, যে স্রষ্টা বলে কারো অস্তিত্বেই বিশ্বাসী না। দাউদ হায়দার, হুমায়ূন আজাদ, ড. আহমদ শরীফ, তসলিমা নাসরিনরা নাস্তিক ছিলেন কারণ, তারা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। তারা ছিলেন স্বঘোষিত নাস্তিক। এছাড়া ইসলাম ও ধর্মীয় ব্যাপারে উল্টা-পাল্টা বললেই বা লিখলেই তাকে নাস্তিক বলা যাবে না।
পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না। ভাববেন না আমি তাদের ডিফেন্স করার চেষ্টা করছি। মোটেও না। আবেগের জগতের বাইরে এসে যা সত্য, তাই তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। যে যা, তাকে তো তাই বলা দরকার। বাড়িয়ে বলার তো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমড়াকে জোর করে জলপাই বানানোর জন্য টানা-হেছড়া করারইবা দরকার কী? আমড়াও তো আর কম টক না। আমি যাদের কথা বলছি যে, তারা নাস্তিক না, তাহলে তারা কী? ধোয়া তুলসীর পাতা? খাঁটি দ্বীনদার ?
মাফ করবেন। আমি সেটা বলি নি। তাদেরও খাঁটি দ্বীনদার হতে কোনো আগ্রহ নেই। তারা কথা কাজ ও লেখনিতে সরাসরি ইসলামের প্রতিপক্ষ। আলেম-উলামা, মাদরাসা ও ইসলামের বিরুদ্ধে বলা ও লেখা তাদের মূল কাজ। নিজেদের নাক কেটে হলেও ইসলামের যাত্রাপথে কাটা বিছাতে তারা বিকৃত ধরনের আনন্দ পান। তারা তাদের এই আনন্দ একে অপরের সাথে শেয়ার করেন। চমৎকার একটি ইউনিটি কাজ করে তাদের মধ্যে। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের কেউ একজন কোনো কথা লিখলে বাকীরা সেটা পড়ে দেখার আগেই সেটাকে সাপোর্ট করে হারমোনিয়ামে একই সুর তুলেন। বলেন, ‘তথাস্তু।’
তথাস্তু’র ব্যাখ্যা কি পাঠকের জানা আছে? জানা না থাকলে আপনার আশেপাশে থাকা কোনো হিন্দু লোকের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিয়েন। সংক্ষেপ ঘটনা হলো, আমাদের হিন্দু ভাইজানরা যখন কোনো বিপদÑআপদে পড়েন, বা তাদের কোনো কিছুর দরকার হয়, তখন তারা তাদের ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। ভগবান তো আর এত অবসর থাকেন না। তিনি থাকেন মহাব্যস্ত। সমস্ত জগত দেখাশুনা করে রাখা তো কম কথা নয়। উপাসকের বিস্তারিত শুনার সময় থাকে না ভগবানের হাতে। তাই যেভাবে চাওয়া হয়, সেভাবেই তিনি কবুল করে নেন। তিনি শুধু বলেন ‘তথান্তু’। এর মানে, ‘তাই হোক।’ ব্যস, প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েগেলো।
বাম ধারার এই লেখকরাও চোখ বন্ধ করে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করে থাকেন। আর একে অপরকে সমর্থন জানান ‘তথাস্তু’ কায়দায়। আমি বাম ধারার যে লেখকদের নাম নিলাম, আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতে যদিও তারা নাস্তিক এর সংজ্ঞায় পড়েন না, কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া (বিষক্রিয়াও পড়া যাবে) সৃষ্টিতে তারা নাস্তিকদের চাইতে কম খতরনাক নন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফেরদেরচে’ মুনাফিকরাই ইসলামের ক্ষতি করেছিলো বেশি। কারণ, ‘ঘরের শত্র“ বিভীষন।’
সাত. দুই মাতাল সন্ধ্যেবেলা তর্ক করছিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে একজন বলছিলো, এটা সূর্য। অন্যজন দাবি করছিলো এটা বড় কোনো তারকা হবে। হঠাৎ সামনে এসেপড়া তৃতীয় এক লোককে তারা টলতে টলতে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ভাই, বলেন তো আকাশে ওঠা কী? সূর্য না তারকা?
লোকটি জবাব দিলো, ‘মাফ করবেন ভাই, আমি এই এলাকায় নতুন এসেছি!’
জবাব জানা আছে। জানা না থাকলে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই জবাব পাওয়া যাবে। তারপরও যদি জবাব আসে প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে, গা বাঁচিয়ে, তাহলে তো হলো না। প্রশ্ন যেভাবে আসবে, জবাব দিতে লাগবে সেভাবেই। কোনো ইসলাম বিদ্ধেষী লেখক, ফুল নাস্তিক বা হাফ নাস্তিক, ইসলাম ও কুরআনের বিরুদ্ধে কিছু লিখে ফেললো। আর তার ফাসি চাই’ র মিছিল দিয়ে মাঠ গরম করে তোলা হলো, এই নীতি কিন্তু পারফেক্ট না। কেউ মুখে বললে মুখে জবাব দিতে লাগবে। লিখে বললে লিখে। জবাব জানা না থাকলে জেনে নিতে হবে। এ পর্যন্ত এদেশে যারাই ইসলাম ও কুরআনের বিরুদ্ধে লেখার দুঃসাহস ও দৃষ্টতা দেখিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ‘ফাসি চাই দিতে হবে’ বলে চিৎকার করে করে গলাভাঙ্গা ছাড়া আর তো কিছুই করা হতে দেখলাম না! তাদের যুক্তির জবাবে যুক্তি খাড়া করে প্রপার ওয়েতে জবাব লিখতে দেখলাম না কাউকে! কেন? যোগ্য লোকের অভাব? নাকি বোঝার অভাব? না পরিকল্পনার? বিষ ঢালা হচ্ছে গাছের গোড়ায়, ডালে ধরে ঝাঁকা ঝাঁকি করে লাভ কী?
চলুন, আমরা সকলে মিলে শুরু করি সুস্থ ধারার লেখকের খোঁজ করা। তাদের খুঁজে বের করি। তাদের নেতত্বে খুলে বসি লেখক তৈরির একটি পাঠশালা। আমরা সেখানে ভর্তি হই। প্রতিভা আছে, ক্ষমতা আছে, যোগ্যতা আছে কিছু লেখার, এমন সবাইকে সেখানে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিই। আগামী প্রজন্মকে কালচারাল বিপর্যয় ও বুদ্ধিভিত্তিক দেউলিয়াপনা থেকে রক্ষা করার জন্য এই কাজটি করা বড় বেশি জরুরী।