আমরা, বাঙালিরা আবেগ প্রবণ জাতি। আবেগের বেগটাও আবার বেশি। আমাদের এই মাত্রাতিরিক্ত আবেগের সাথে দুর্বল বিবেকের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হেরে যায় বিবেক, আবেগের কাছে। সময়ের স্রোতে পাল তুলে দিয়ে বসে থাকি আমরা, নিরবে। যাচ্ছি কোথায়, না ভেবেই। গন্তব্য ঠিক আছে কি না, না জেনেই। জোশের সাথে হুশ্ ঠিক থাকা দরকার। প্রায়ই আমাদের থাকে না। অনাহারির মুখে খাবার তুলে দেবো, ভাল কথা। কিন্তু ভাই বোন-স্ত্রী সন্তানের মুখের আহার কেড়ে নিয়ে? বাইরের মেহমানকে সম্মান জানাবো, ভাল কথা। তাই বলে কি তাকে পিতার আসনে বসিয়ে দিয়ে? মাকে অপমান করে? এমন উদ্ভট কান্ড-কারখানা যদি করে কেউ, ব্যক্তি জীবনে, তাহলে তার শুভ বুদ্ধির প্রত্যাশাই করার থাকবে শুধু। কিন্তু ব্যাপারটি যদি হয় সমষ্টিক, এর এ্যাফেক্ট যদি এসে পড়ে পুরো জাতির উপর, তাহলে এ নিয়ে কথা বলবার এবং আপত্তি জানাবার যথেষ্ট কারণ ও যৌক্তিকতা রয়েছে।
দুই//
মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে আনুসাঙ্গিক কিছু প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার। এমন নয় যে, একাত্তরের আগে আমরা খেতে পরতে পারতাম না। তবে কেন একাত্তরের প্রয়োজন ছিলো? এমন তো নয় যে, বাহান্নর আগে আমরা বাংলায় কথাই বলতে পারতাম না! বাংলা বললে কেউ এসে ঠুটি চেপে ধরতো! তবুও বাহান্নর প্রয়োজন ছিলো কেন? সাতচলি¬শের আগে কি আমরা আমাদের বাড়িঘরে থাকতে পারতাম না? তবে কেন সাদাদের বিরুদ্ধে লড়ে রক্ত ঝরানো? কেন তবে সাতচল্লিশের পার্টিশন?
জবাব অনেক। আবার একটাই জবাব, অধিকার ও আত্মমর্যাদা। মূলত এই দুটি শব্দের জন্যই সাতচলি¬শ, বাহান্ন এবং একাত্তুরের জন্ম। লক্ষ লক্ষ মানুষ যুগেযুগে তাদের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে আমাদের অধিকার, আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচবো বলে। এখন আমরা যদি সেটা ধরেও রাখতে না পারি, আমরা যদি আমাদের অহংকারের সফেদ চাদরে কালো দাগ বসিয়ে দেই, যদি কলংকের তিলক এঁকে দেই আত্মপরিচয়ের সনদে, তাহলে সেটা যে আমাদের জাতিগত আত্মহত্যাই হবে, কখনো ভেবে দেখেছি?
তিন//
সারাবিশ্বে একটি জ্বর এসেছে। চার বছর পর পরই আসে। বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বর। ঝড়ের মতো জ্বর। এ জ্বরে আক্রান্ত বিশ্বের ৫শ কোটি মানুষ। আমরা বাংদেশিরাও পিছিয়ে নেই। লাফালাফিটা আমরাও কম করছিনা। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে নেই। অদূর ভবিষ্যতে কখনো যেতে পারবে, এমন দুঃস্বপ্ন দেখার মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও উতসাহে-উতসবে কমতি নেই কোনো। লাফালাফিটা আমরা ঠিকই করে যাচ্ছি। ছাগলের সেই তৃতীয় বাচ্ছাটির মতো। ছাগলের দুই বাচ্ছা দুধ খেয়ে লাফায় আর তৃতীয়টি এমনিতেই তিরিং বিরিং করে। বাংলাদেশের মানুষ আজ আওয়ামীলীগ-বিএনপি নয়, ব্রাজিল আর্জেন্টিনায় বিভক্ত। কোনো এক বিকেলে ম্যারাডোনাকে বলা হয়েছিলো আপনি কি জানেন বাংলাদেশে আপনার কয়েক কোটি ভক্ত রয়েছে? তিনি বিষ্মত হয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ! সেটা আবার কোথায়? কখনো নাম শুনিনি তো! আর পেলেকে এখনো জিজ্ঞেস করার সুযোগই পাওয়া যায়নি যে, জনাব, বাংলাদেশ নামের ছোট্ট একটি দেশ আছে। সেখানে আপনার ব্রাজিলের রয়েছে অসংখ্য সমর্থক। আপনি কি এটা জানেন! তার পরও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ল্যাটিন আমেরিকার এই দুই দেশের নামে কুরবান।
অবশ্য এদেশের ফুটবল প্রেমী মানুষ ব্রাজিলকে সমর্থন করলো কি আর্জেন্টিনাকে করলো, পর্তুগালকে করলো নাকি আইভরিকোস্টকে, আমাদের কিছু যায় আসে না। করুক সমর্থন যার যাকে খুশি। রাত জেগে, সারারাত, খেলা দেখুক। পেটের দায়ে ঘুম পূর্ণ না করেই সকাল ৮ টায় বেরিয়ে যাক অফিসে, দোকানে, কর্মস্থলে। সারাদিন কাঠবেড়ালীর মতো চেহারাটাকে ভোতা বানিয়ে টেবিলে বসে ঝিমাক। অথবা চোখ টেনে জেগে থেকে গত রাতের খেলা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন করুক। বিশেষজ্ঞ মতামত দিক। খেলার মধ্যখানে ২০ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের চৌদ্দগোষ্ঠির রুহের উপরও কিছু ঝাড়ুক, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। ফেলুক পানি প্রিয় দলের পরাজয়ে। করুক চিৎকার যত জোরে ইচ্ছে। গলার রগটি কেবল না ছিড়লেই হলো।
চার//
মূল কথায় চলে আসি। এই মুহুর্তে বাংলাদেশে সব'চে রমরমা ব্যবসাটির নাম পতাকা ব্যবসা। এক জরিপে দেখা গেছে সারাদেশে ইতোমধ্যে ৩০ লাখেরও বেশি পতাকা তৈরি হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এই সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এগুলো আমাদের লাল-সবুজের পতাকা নয়। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার। কিছু আছে ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানীর। তবে অধিপত্য ল্যাটিন আমেরিকারই। কিছুদিন আগে ইউরোপের আকাশটা ভয়ংকরভাবে ছেয়ে গিয়েছিলো ছাই মেঘে। আইসল্যান্ড থেকে নির্গত আগ্নেয়গিরির লাভায় জন্ম হয়েছিলো ভয়াবহ এক অবস্থার। এক অর্থে তারচেও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের আকাশটা আজ ছেয়ে গেছে ব্রাজিলÑআর্জেন্টিনার পতাকায়! আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম আকাশে উড়ছে অন্যদেশের জাতীয় পতাকা! ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে একটি চমৎকার পতাকা দিয়ে গেছে আমাদের। দিয়ে গেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখন্ড, স্বাধীন করে। সঙ্গত কারণে এবং অবশ্যই বিধিবদ্ধ কারণে, বাংলাদেশের আকাশে একমাত্র লাল সবুজ পতাকাই উড়ার অধিকার রাখে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার নয়। অন্য কারো নয়। এই ফাঁকে বলে রাখা যায়, বাংলাদেশস্থ বিদেশি দূতাবাসগুলোতে স্ব স্ব দেশের জাতীয় পতাকা টানানো হয়। হতেই পারে। বাংলাদেশের সাথে অন্য এক বা একাধিক দেশের দ্বি-পাক্ষিক বা বহুপক্ষীয় কোনো চুক্তি বা সভা হলে সেখানে সকল দেশের পতাকা টানানো হয়। সব দেশেই হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে নিজ দেশের পতাকাকে রাখতে হয় মধ্যখানে এবং একটু উঁচুতে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কারণে অন্যদেশের পতাকা টানানোর কোনো অধিকার তো কাউকে আমার সংবিধান দেয় নি।
আমি জানি না আমাদের আইনের ধারা এক্ষেত্রে কী বলে? আইনে যদি বলা হয়ে থাকে স্বাধীন বাংলার আকাশে অন্যদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো যাবে, তাহলে তীব্র ভাষায় আমরা বলবো, এ আইন আমরা মানি না। আমরা আমাদের লাল সবুজের স্থানে অন্য কাউকে সহ্য করতে রাজি নই। তবে আশা করা উচিৎ এদেশে এমন উদ্ভট কোনো আইন নেই। এবারে প্রশ্ন হলো, স্বাধীন এই দেশে ভিন্নদেশের জাতীয় পতাকা টানানো বৈধ কি না! যদি বৈধ না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপক্ষ নিরব কেন? সরকারের কাছে কি মনে হচ্ছেনা এই পতাকা সংস্কৃতি বন্ধ করা দরকার? এক বছর পর যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসবে, তখন অতি উৎসাহী কোনো সমর্থক যদি তার পছন্দের দল পাকিস্থানের চাঁদতারা খচিত পতাকাটি আমার দেশে টানিয়ে দেয়, তখন নীতিগতভাবে কি কিছু বলার থাকবে? আইনগতভাবে কি কিছু করার থাকবে? তার পক্ষে কি কোনো জাদরেল আইনজীবি দাঁড়িয়ে যাবেন না? বলবেন না, খেলার সমর্থক হিসেবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বা পাকিস্থান সবগুলোর পতাকা টানানোর হুকুমই সমান হবার কথা। এদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা টানানো বৈধ হলে পাকিস্থানেরটা অবৈধ হবে কেন? তখন কী হবে অবস্থা? আর এভাবে আইনের ফাঁক গলে বর্বর পাকিস্থানিদের অই পতাকা, যেটি আমরা ছিন্ন ভিন্ন করে ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে এসেছি, যদি আমাদের আকাশে কিছু সময়ের জন্যও বৈধতা পেয়ে যায়, তাহলে একাত্তরের শহীদদের কাছে কী জবাব দেবো আমরা?
পাঁচ//
আমি জানি, এবং বেশ ভাল করেই জানি, আমি যদি আমার বাড়ি বা গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দেই, তাহলে বিধিগত কারণেই আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাবে। কারণ, ন্যূনতম প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার নিচের কারো পতাকা ব্যবহারের সাংবিধানিক সুযোগ নেই। আমরা সাধারণ মানুষ পতাকা ব্যবহারের সুযোগ পাই ১৬ই ডিসেম্বর ২৬শে মার্চের মত কয়েকটি দিবসে। এটা ঠিক আছে। জাতীয় পতাকার একটা মর্যাদা আছে। যেন-তেন লোক পতাকা ব্যবহার করলে পতাকার আর ইমেজ থাকলো কই! আমার দেশের অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার তাদের ভয়াবহ দেশপ্রেমে উতলা হয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মাথার উপরে লাল-সবুজের পতাকাও লাগিয়ে রেখেছেন। আইনের চোখে তো এটারও বৈধতা নেই। জাতীয় পতাকা তো খেলা করার বিষয় নয়।
যারা আমার স্বাধীন দেশে, বুঝে হোক আর না বুঝে, আবেগে হোক আর হুজুগে, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার, অন্যদেশের জাতীয় পতাকা টানিয়ে রেখেছে, তাদেরকে সতর্ক করা দরকার। এই অশুভ কালচারের বিরুদ্ধে সরকারের নমনীয়তা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। ৩০ লাখ লোক জীবন দিয়ে কিনে দিয়ে গেছে আমাদের পতাকাটি। এই পতাকার সাথে বা স্থলে অন্যদেশের পতাকা উড়ানো তো আমাদের পতাকাটিকে অপমান করা। আর লাল সবুজের চমৎকার এই পতাকাটিকে অপমান করার কোনো অধিকারই কারো নেই। কারোই নেই।