সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০১১

শুরু হোক তবে শোষক বিতর্ক

একাত্তরের ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। ঘোষণাটি কে দিয়েছিলেন, সেটা আমি জানিনা! তখন আমার জন্ম হয়নি। যাদের হয়েছিলো, যারা যুদ্ধ করেছেন, তারা সঠিক করে বলতে পারছেন না কিছু! কেউ বলেন অমুক তো কেউ বলেন তমুক! জানিনা কে সত্য বলছেন আর...
কাকে মিথ্যাবাদী বলি! আমরা কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে মিথ্যাবাদী বলে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করতে চাই না।

অবশ্য উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। কেউ গ্রহণ করছেন কেউ আবার প্রকাশ্যেই বিরোধিতা করছেন। আমরা সাধারণ মানুষ পরেছি মহা মুশকিলে। আমরা আমাদের ছোটভাই/বোনদের জানাতে পারছিনা কিছু! তারা যখন জানতে চাইছে, আমরা তখন জবাব দিতে পারছিনা। জবাব জানলে তো!


স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা ঐক্যমত্তে পৌঁছাতে পারিনি স্বাধীনতার ঘোষণাটি কে দিয়েছিলেন? ৫ বছর পর পর ঘোষক পরিবর্তন হন! পৃ্থিবীতে সম্ভবত আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ৫ বছর পর পর ইতিহাস তৈরি করি!


আশ্চর্য আমাদের বিবেক! কে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে এতো পেরেশানি, কিন্তু কেনো দিয়েছিলেন, যে জন্যে দিয়েছিলেন, সেই উদ্দেশ্যটি কি সফল হয়েছে, দেশ কি সার্বিক অর্থে আত্মনির্ভর হতে পেরেছে, না পারলে কেনো পারেনি, কে দায়ী, গলদ কোথায়, শোধরানোর উপায় কি...এগুলো নিয়ে মোটেও ভাবিনা! আবার আমরা স্বপ্ন দেখি এগিয়ে যাবার!!


আর তাই আমরা ভিন্ন পথ ধরতে পারি। আমরা যারা একাত্তর পরবর্তি প্রজন্ম, আমরা ঘোষক বিতর্কে না গিয়ে অন্য বিতর্কে জড়াতে পারি। সেটা হচ্ছে শোষক বিতর্ক। স্বাধীনতার পর থেকেই তো আমরা আম জনতা শোষিত হয়ে আসছি। যাদেরকেই আমরা বিশ্বাস করেছি, ক্ষমতা দিয়েছি, আমাদের বিশ্বাসের পিঠে ছুরি বসাতে তারা কেউই ভুল করেন নি!


আমরা আমাদের বিশ্বাসের আঙুলগুলো তুলে দিয়েছি তাদের মুঠোয়, তারা মুড়িয়ে দিয়েছেন!

আমরা আমাদের আস্থার হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছি তাদের দিকে, তারা হাতটি আমাদের গুড়িয়ে দিয়েছেন!

আমরা আমাদের জীবনের ফায়সালা করবার দায়িত্ব দিয়েছি তাদের কাছে, তারা আমাদের নিয়ে দাবা খেলেছেন! তাদের চৌকস চালে আমরা এক একটি গুটি হারিয়ে গেছি পৃ্থিবী নামের বোর্ড থেকে!


আর কতো? আমরা কেনো ঘুমিয়েই কাটাবো সময়। আসুন কিছু করি। নেতারা করুন ঘোষক বিতর্ক। আমরা করি শোষক বিতর্ক। কে আমাদের কতো বেশি শোষন করার কৃ্তিত্ব দেখালেন, সেটা জরিপ করতে শুরু করি।


এতে লাভ কী?

আমাদের কোনো লাভ হোক আর না হোক, আগামী প্রজন্মের অনেক লাভ হবে। তারা আমাদের মতো মানুষ চিনতে ভুল করবেনা। ধোকা খাবেনা।

কাজটি আমরা করতে পারি। মন্দ হবেনা আশাকরি ।

শনিবার, ২৬ মার্চ, ২০১১

দেশ তুমি কার ?

যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তেমন স্বাধীনতা কি চেয়েছিলাম? আর যে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম তেমন স্বাধীনতা কী আমরা পেয়েছি?

৪০ বছর পেরিয়ে গেছে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। কিন্তু এখনো প্রশ্নটি সচেতন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে বেড়ায়, প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে। একটি পতাকা এবং স্বতন্ত্র ভূ-খণ্ডের মাঝেই যদি আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে যাই, অথবা তৃপ্তি , তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।


শুধু আলাদা ভূ-খন্ড ও পতাকার নামই কি স্বাধীনতা?


স্বাধীনতা মানে তো অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা। আমরা কি সেটা পারছি?

স্বাধীনতা মানে তো নতজানু নীতি থেকে বেরিয়ে আসা। আমরা কী পেরেছি?
তাহলে এত বিদেশ তোষণ কেন?

স্বাধীনতা মানে তো স্বয়ং সম্পূর্ণতা। আমরা কী হতে পেরেছি? তাহলে বারবার কেন আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য নির্লজ্জের মত হাত বাড়াচ্ছি বিদেশিদের দিকে?


বিজয় মানে তো পরাজয় এর গ্লানি গা থেকে ঝেড়ে ফেলা। আমরা কি সেটা করতে পেরেছি? তবে কেনো সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কাছে অসহায় আত্ম সমর্পন!


বিজয় মানে তো বীরত্বের গৌরব গাঁথা। তাহলে বারবার কেনো আমরা কাপুরুষের মত বিদেশিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও কটুকথা হজম করে যাচ্ছি!!


কে দেবে জবাব? কার কাছে চাইবো আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর?

আওয়ামীলীগের কাছে?
বিএনপি’র কাছে?

সামরিক সরকারের শাসনামল ছাড়া বাংলাদেশের পুরোটা সময়তো পালাক্রমে এই দু'টি দলই শাসন করলো। কী দিয়েছে তারা আমাদের? কী করেছে তারা আমাদের জন্য? বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তাদের কোনো অবদান আছে কী? দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানানো ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আমাদের জন্য তারা আর কী করেছেন?


তারা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করার প্লান-প্রোগ্রামে যে সময় ব্যয় করেন, সেই সময়টুকুই যদি দেশের জন্য দিতেন, নিঃসার্থ হয়ে, তাহলে বাংলাদেশকে কি অনেক উপরে উঠে যেত না? পরিবারতন্ত্রের খপ্পর থেকে আমরা কি কখনো মুক্তি পাবো না? পরিবারতন্ত্রের গ্যাড়াকল থেকে কবে বেরুবে আমাদের গণতন্ত্র?


দল-নিরপেক্ষ একজন সচেতন নাগরিক তো প্রশ্ন করতেই পারে বাংলাদেশ তুমি কার?

আওয়ামীলীগের?
বিএনপি’র?
অথবা আরেকটু সাহস করে বলতে পারে বাংলাদেশ তুমি কার?
খালেদা জিয়ার?
নাকি শেখ হাসিনার?

দুই

স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমরা ভুলে বসে আছি। ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে এই দেশটি স্বাধীন করে এ জন্য দিয়ে যায়নি যে, আমরা যা ইচ্ছা তাই করবো। যেমন খুশি, তেমন চলবো। তারা চেয়েছিলো তাদের বাংলাদেশের মানুষগুলো মাথা উচু করে বাঁচবে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবে। সর্বোপরি নিঃশর্তভাবে দেশকে ভালবাসবে। শুধুই বাংলাদেশকে। আমরা যদি সেটা করতে না পারি, তাহলে স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মাঝে ব্যবধান থাকলো কই?

২৬শে মার্চ এসেছে। প্রতি বছরই একবার করে আসে। আমাদের জানিয়ে দিতে যে, আমরা কতো বড় অকৃতজ্ঞ। আমরা সেটা গায়ে মাখি না। লজ্জা আমাদের থেকে কতো আলোক বর্ষ দূরে চলে গেছে-কে জানে! আমরা পুরুষরা লজ্জা পাইনা কারণ, লজ্জা নারীর ভূষণ! নারীরা পাইনা কারণ পুরুষের সমান অধিকারের যুগ!


আর এভাবেই নির্লজ্জতা, নিমকহারামী, অকৃতজ্ঞতা ও বেঈমানিকে নিত্য সঙ্গি করেই আমাদের অদ্ভুত জীবন চলা!!


আজব এক দেশে বাস করি আমরা। এক দেশে ছিলো এক রাজা... টাইপ দেশগুলোতেও মনে হয় এই অবস্থা নেই! এদেশে আমরা রাজাকারকেও রাষ্ট্রপতি বানাই! স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে পতাকা টানিয়ে দেই! মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ফিরেও তাকাই না। যদি তাকাই-ও, সেটা মরার পরে! জীবিতদের শরীরে দেশদ্রোহিতার গন্ধ খুঁজি। পেয়েও যাই!। তাকে ফাসির সুসংবাদ(!) পর্যন্ত শোনাতে দ্বিধা করি না। মেজর জলিলরা, কর্ণেল তাহেররা, মুক্তিযোদ্ধারা এভাবেই যুগে যুগে আমাদের দ্বারা পুরস্কৃত হয়ে থাকেন!!!


তিন

আমরা ছিলাম পাকিস্তান নামক একটি দেশের খাদ্য। ২৪টি বছর তারা আমাদের ঘাড়ে চেপে রয়েছে তারা। লেবু চিপে রস বের করার মতো বের করে নিয়েছে আমাদের শরীরের যত রক্ত। স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাসটুকু পর্যন্ত নিতে দেয়নি আমাদের! অনেকটা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটপট করছিলো তখন সাড়ে সাতকোটি বাঙালি। এই অবস্থায় রুখে দাঁড়ানো হয়ে পড়েছিলো অনিবার্য। রুখে দাঁড়ালো সোয়া সাতকোটি মানুষ।
(নিরব ও রাজাকারের আনুমানিক সংখ্যা বাদ দেয়া হলো)

২৬শে মার্চ ১৯৭১ থেকে নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮ মাস ২২ দিনে ৩০ লক্ষ জীবন এবং ২ লক্ষ সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেলাম সতন্ত্র একটি পতাকা, লাল-সবুজ। অথচ, যাদের জন্য আজ আমরা মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, তাঁরা কিন্তু ভোগছে শ্বাস কষ্টে! ফিরে তাকাবার সময় নেই আমাদের!


পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা পা হারিয়ে ঘরে বসে আছে আজ ৪০ বছর হলো। থাকুক বসে, আমাদের কী! আমরা আমাদের পায়ে সামান্য ব্যথা হলে ছুটে যাচ্ছি মাউন্ট এলিজাবেত কিংবা কিং ফাহাদে।!


বোমার বিকট শব্দে শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে মানুষটি বেঁচে আছে ৩৯ বছর ধরে, মরার মতো। আমাদের কী! আমরা তো আমাদের কানের চিকিৎসায় ছুটে যেতে পারছি আমেরিকায়?

আচ্ছা আমাদের হলোটা কী?

আবার ফিরে এসেছে মার্চ। কদর বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। ২৬ কে কেন্দ্রকরে মৌসুমী দেশ প্রেমিকদের চেতনা উতলে উঠবে।

কিছু ফুল দেয়া হবে
কিছু পদক বিতরণ হবে
কিছু আলোচনা সভা হবে
কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্টান হবে
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কিছু বিতর্ক হবে
এই তো!!

জীবিত থাকতে খোঁজ-খবর নেয়ার দরকার মনে না করলেও কিছু মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী বা এতিম ছেলের ধরে এনে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে একটি তোষা শিরিণি'র প্যাকেট। যার কেতাবী নাম-মরণোত্তর।



আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করতাম,-


জীবিত থাকতে আমরা তোমাদের খোঁজ নিই নি! খুব যখন বাঁচতে চাইছিলে, আমরা এগিয়ে আসি নি! আর আজ,তুমি যখন নেই, আমরা তোমাকে মরণোত্তর পদক দিচ্ছি!

তুমি কি খুব খুশি হয়েছো?

আজ আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, প্রিয় মুক্তিযুদ্ধ! প্রিয় স্বাধীনতা! তোমরা কিছু মনে করোনা। আমরা ততোটা অকৃ্তজ্ঞ না যতটা ভাবছো! আর না হোক, প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর এবং ২৬শে মার্চ তোমাদের স্মরণ করবো। কথা দিলাম।


তাতে যদি সন্তুষ্ট হতে না পারো, অপেক্ষা করতে হবে। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। এদেশে একটি নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, যারা আওয়ামীলীগ-বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি মার্কা রাজনৈতিক বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে নেই। যারা রাজনীতি করেনা, রাজনীতির মারপ্যাঁচও বুঝেনা। শুধু বুঝে দেশকে ভালোবাসতে হবে। শুধুই দেশকে।


এদের সংখ্যা বাড়ছে। দিনদিন বাড়ছে। একদিন তার সেই বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যে দেশটির স্বপ্ন দেখে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছিলো আমার ভাই। তার আগ পর্যন্ত,প্রিয় স্বাধীনতা, আমাদের ক্ষমা করে দিও

রক্তচোষা এক মহান জাদুকর !


সুফিয়া খাতুন মারা গেছেন বারো বছর আগে, ১৯৯৮ সালে। সহায়-সম্ভলহীন এই মানুষটি মারা যাবার পর কাফন-দাফনের পয়সাও ছিলোনা পরিবারের কাছে। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে তাঁর দাফনের ব্যবস্থা করে। অথচ:এই সুফিয়া আন্তর্জাতিক  বিশ্বের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। একজন স্বচ্ছল-স্বাবলম্ভি মহিলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। আমি চট্রগ্রামের জোবরা গ্রামের শিকদারপাড়ার সেই সুফিয়ার কথাই বলছি, আজ থেকে ৩৬ বছর আগে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত এক শিক্ষক, মুহাম্মদ ইউনুস নামের এক ব্যক্তি যে মেয়েটিকে মাত্র ২০ টাকা ঋণ দিয়ে শুরু করেছিলেন সুদের রমরমা বিজনেস, ক্ষুদ্র ঋণের মহাজনী ব্যবসা।

সময় গড়িয়ে যায়। সুফিয়া সুফিয়াই থেকে যান। তাঁর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আর হয় না। অনাহারে-অর্ধাহারে এবং বিনা টিকিৎসায় একদিন মারা যান সুফিয়া। আর সুফিয়াদের মার্কেটিং করে অখ্যাত সেই শিক্ষক হয়ে যান বিখ্যাত।  অশান্তিতে ছটপট করতে করতে মারা যেতে থাকে সুফিয়ারা। বিখ্যাত সেই মহাজন পেয়ে যান শান্তির নোবেল!
সুফিয়াদের কথায় পরে আসছি। তার আগে কিছু খুচরো কথা।
আমাদের দেশে ‘ভাবমূর্তি’ নামের অতি স্পর্শকাতর একটি বস্তু আছে। এটি থাকে কচুপাতার উপরে। সবসময় টলমল করতে থাকে। কখন পড়ে যায় কখন পড়ে যায় অবস্থা! এক শ্রেণীর মানুষও আছেন এদেশে। যাদের কেতাবি নাম সুশীল শ্রেণী। তাদের সকল কর্মকাণ্ড এই কচুপাতায় থাকা বস্তুকে ঘিরেই পরিচালিত হয়। সকাল-সন্ধ্যা তারা মত্ত থাকেন ভাবমূর্তি বন্দনায়। কচুগাছটির গোড়ায় নিয়মিত পানি দিতে নসিহত করে বেড়ান অথচ নিজেরা ভুলেও এই কাজটি কখনো করেন না।
 ড.ইউনুসের পাপ বালেগ হয়ে যাবার পর তাকে অপসারণ করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে। বিধি অনুযায়ী ইউনুস ষাট বছর বয়স পর্যন্ত এই পদে থাকবার যোগ্যতা রাখেন। হযরতের বর্তমান বয়স একাত্তর। ব্যাপারটি তাকে জানানোও হয়েছিলো বারবার। বলা হয়েছিলো আপনি সম্মানী মানুষ। সম্মান নিয়ে সরে পড়–ন। তিনি সরেননি। লাখো গরিবের চোখের পানি ঝরেছে যার কারণে, অসংখ্য অসহায়ের বুকফাঁটা অভিশাপের মালা ঝুলে রয়েছে যার গলায়, সম্মান অবশ্য তার ভাগ্যে ঝুটার কথাও নয়।
সিদ্ধান্তটি মেনে নিলেন না ইউনুস। গেলেন উচ্চ আদালতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে  আদালতকে তিনি বললেন, আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। আমি আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে চাই। ওরা থাকতে দিতে রাজি হচ্ছে না। বলে দেয়া হোক আমাকে যেনো থাকতে দেয়া হয়।
মহামান্য আদালত ফরিয়াদটি  তিনদিন ধরে শুনলেন। কাগজপত্র দেখলেন। সবকথা বিচার-বিশ্লেষণ করলেন। তারপর বললেন, ইউনুস সাহেব! কিছু মনে করবেন না। আপনাকে অব্যহতি দেয়ার আদেশটি সঠিকভাবেই দেয়া হয়েছে। আপনি অনেকদিন বে-আইনিভাবে পদে ছিলেন। আর না থাকাই ভালো। আইনের চোখে সবাই সমান।
এই যখন অবস্থা, তখন আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ করছি ইউনুস ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন সুশীল শ্রেণীর স্বঘোষিত ঠিকাদাররা। ইউনুসের মতো এতো বড়মাপের একজন বুজুর্গকে যে অপমান করা হয়েছে এবং এতেকরে দেশের ভাবমূর্তি যে একেবারেই শেষ হয়ে যাচ্ছে,  সে ব্যাপারে চিৎকার করে বলতে শুরু করেছেন তাঁরা। পশ্চিমপাড়ার বন্ধুদের নজর কাড়ার জন্য হোক আর  দেশি-বিদেশি মক্কেলদের নিমকহালালীর জন্যই হোক, ইউনুসের জন্য তাদের দরদ সাংঘাতিকভাবে উতলে উঠেছে! একচোখা এই বুদ্ধির ফেরিওয়ালাদের  চোখের সামনে একবারও ভেসে উঠছেনা ইউনুসের প্যাঁচে পড়ে পথে নামা এদেশের অসহায় মানুষের ফুটো হয়ে যাওয়া মুখগুলো।  তাদের চোখে পড়ছেনা ইউনুস সাহেবের অন্যায় আস্থাভাজন হতে না পারায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চাকরি খোয়ানো সাড়ে ৮ হাজার মানুষের বিধ্বস্ত চেহারাগুলো।  ইউনুস সাহেবের সম্মান আছে, গরিবের বুঝি সম্মান থাকতে নেই? হায়রে বুদ্ধিজীবি! মূর্খতাই তবে কেনো শ্রেয় হবে না?
ইউনুস সাহেবের বিদেশি বন্ধুরা তাকে নিয়ে পেরেশান। মরিয়াটিদের দৌড়-ঝাপ দেখে মনে হচ্ছে বর্তমানে কাজ তাদের একটাই, যে কোনো উপায়ে তাদের বন্ধুকে যথাস্থানে জিন্দা রাখা। আর এটা করতে গিয়ে সকল নিয়ম-নীতি লঙ্গন করে  কুটনৈতিক শিষ্টাচার বেমালুম ভুলে গিয়ে এমনভাবে কথা বলে চলেছেন তাঁরা, যেভাবে বলবার কোনো অধিকারই তাদের নেই। আমার দেশের তথাকথিত সুশীলরা একটিবারও বলতে পারছেন না গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান। ড.ইউনুসও একজন বাঙালি। সুতরাং এটি আমাদের ঘরোয়া বিষয়। এখানে আমরা আমাদের আইনে যা খুশি, তাই করবো। তোমরা কথা বলার কে?
দুই\
ড. ইউনুসকে অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না দেয়ায় মারাতœক গোস্বা করেছে আমেরিকা। খুব ঘনঘন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা টাইপ শব্দ কচলাচ্ছে তারা আজকাল। আমরা সাধারণ মানুষ ভেবে পাচ্ছিনা এখানে তাদের এতো পেরেশান হবার কারণ কী? তারা কেনো বুঝতে চাইবেনা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে যে কোনো সিদ্ধান্তই আমরা নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রেসক্রিপশনের কোনো দরকার নেই। হিলারি ক্লিনটন বা ক্লিনটন ফ্যামিলির সাথে ইউনুস সাহেবের সু-সম্পর্ক থাকতে পারে। ইউনুস সাহেব কখনো কোনো মুচলেকা-টুচলেকা দিয়ে থাকলে তিনি হয়তো তাদের কাছে ধরা থাকতে পারেন। কিন্তু দেশের ষোল কোটি মানুষের তো কোনো দায় নেই কারো কাছে।
আমার খুব মনে পড়ছে ৩৯ বছর আগের কথা। মার্চ মাস চলছে। আজ থেকে ৩৯ বছর আগে এমনি এক মার্চের ২৬ তারিখ আমরা শুরু করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আমেরিকা সেদিনও আমাদের বিরোধীতা করেছিলো। জালিমের পক্ষেই থাকে তাদের অবস্থান। পশ্চিম পাকিস্তানি কুকুরগুলো যখন পাগল হয়ে গিয়েছিলো, পাখির মতো গুলিকরে মারছিলো আমার ভাইকে, তখনও আমেরিকা ছিলো তাদের পক্ষে। এমনকি আমাদের মারবার জন্য নৌ-বহর পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এরা স্বাধীনতার আগেও আমাদের মেনে নেয়নি, পরেও না। সদ্য-স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত আমার দেশটি নিয়ে সেদিন তারা কম নাক সিটকায়নি। হেনরি কিসিন্জাররা আমার দেশকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো। বলতো, বটমলেস বাস্কেট, তলাবিহীন ঝুড়ি!
 সেই আমেরিকা আজ আমার দেশের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার নিয়ে শুধু নাকই গলাচ্ছে না, রীতিমতো মাথাটাই ঢুকিয়ে দিতে চাইছে!  একজন ইউনুসের জন্য  এতো মায়া কেনো তাদের? কারণটা কী? 
 নিজ দেশের হাজার হাজার মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়া একজন মানুষ পেয়ে যান শান্তিতে নোবেল! রাজনীতিবিদ না হয়েও দম্ভের সাথে ঘোষণা করতে পারেন, দুই নেত্রীকে একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা দরকার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় যখন দেশে সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, তখন কোন খুটির জোরে ইউনুস সাহেব নাগরিক শক্তি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের পায়তারা করতে পারলেন, মাইনাস টু থিওরি বাজারজাত করণের ঠিকাদারী... এই ধরণের বিষয়গুলোকে সামনে রাখলে এবং নির্মোহ পর্যালোচনা করতে পারলে কারণটা স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা। আমেরিকার বড় ইচ্ছে ইউনুস সাহেবের নামটি পরিবর্তন করে নতুন একটি নাম রাখা। সেই নামটি হবে হামিদ কারজাঈ! এটা কি আমার দেশের তথাকথিত সেই সুশীল শ্রেণী বুঝতে পারছেন? না পারলে তাদেরকে আর লেখাপড়া করতে বলেছিলো কে?
 অনেকের কাছেই একটি ব্যাপার স্পষ্ট নয়। শান্তিতে নোবেল পাবার জন্য ড. ইউনুসের ব্যাকগ্রাউন্ডটা কী ছিলো? সুদের কারবারি হলেও তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। তাকে অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া হলেও না হয় একটা কথা ছিলো। দেয়া হলো শান্তিতে! ঘটনা কী?
স¤প্রতি আমি একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি। সে অলোকে একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছি। সেটা এরকম,
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ মেহনতে ৮ টি এনজিও’র মাধ্যমে পার্বত্য চট্রগ্রামের চারটি জেলায় মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বি মানুষকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করার কর্মকাণ্ড বেশ জোরেসুরেই চলছে। শতশত কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। সস্থির কথা হচ্ছে বিষয়টি আমাদের সরকারের নজরেও এসেছে। উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত চলছে। আমাদের স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সুবহান জানিয়েছেন,পার্বত্য অঞ্চলের এনজিওগুলোর কাজ সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রতারকদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
আর সম্ভবত পার্বত্য চট্রগ্রামের চার জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের মানুষকে ছলে বলে কলে কৌশলে ধর্মান্তরিত করা এবং মওকা বুঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গোষ্টীকে উসকে দিয়ে দেশের অখণ্ডতার পাঁজরে আঘাত বসানো এবং অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে, এই কাজটির গোপন কোনো কন্টাক্ট ইউনুস সাহেবকে দেয়া হয়ে থাকলে শান্তিতে নোবেলের সার্থকতা প্রশ্নাতীত। কাজটি ঠান্ডা মাথায় এবং শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে!
তিন \
প্রসঙ্গক্রমে আবার চলে আসে সুশীল শ্রেণীর কথা। ড. ইউনুসের জন্য তাদের অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে! হতেই পারে। নুন, দেশি হোক বা বিদেশি, খেলে তো গুণ গাইতেই হয়। ড. ইউনুসের মতো একজন ধোয়া তুলসির পাতাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করার কারণে দেশের ভাবমূর্তি কত হাত মাটির নিচে চলে গেছে, সেটা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত! দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার এই মিছিলে শরীক হয়েছেন দেশনেত্রীও, সদলবলে। ইউনুস সাহেবের পক্ষে বিবৃতির ফুলঝুরি বর্ষিত হচ্ছে বেগম জিয়ার মুখ থেকে। এই ইস্যুতে আবার হরতাল-টরতাল ডেকে বসেন কি না-কে জানে!
বিএনপি দেশের প্রধান বিরোধীদল। বিরোধীদলের মানে কি সরকার যা করবে, সব কাজেরই বিরোধীতা করা? ড. ইউনুসের ঋণ বাণিজ্যের পাল্লায় পড়ে সর্বশ্রান্ত হওয়া এদেশের হাজার হাজার মানুষের দুর্গতি বেগম জিয়াকে বিচলিত করলো না!  ইউনুস সাহেবের কল্যাণে বাড়িঘর বিক্রি করে খোলা আকাশের নিচে বাস করতে থাকা এদেশের অসংখ্য মানুষের দুর্দশা নেত্রীকে কষ্ট দিলো না! তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইউনুস সাহেবের ভাবমূর্তি নিয়ে!  হায়রে বাংলাদেশের রাজনীতি!!
 বেগম খালেদা জিয়া এবং ড. ইউনুসের জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামা মুরব্বীরা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের আমলনামার কথা ভুলে গেছেন। সমস্যা নেই। আমরা ছোট’রা আছি কী জন্যে! ইউনুস সাহেবের সুকীর্তি’র অতি সামান্য কিছু চিত্র সামনে নিয়ে আসলে তাদের মনে পড়বে ইউনুস কতো মহৎ!
ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা (নাকি প্রভোক্তা), দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা দেয়া ড. মুহাম্মদ ইউনুস নিজেই হয়ে যান দারিদ্রের বহুরূপী এক জাদুকর! এই ভদ্রলোকের সুদভিত্তিক আমলনামা এতই বড় ও বিস্তৃত যে, জেনে ও লিখে শেষ করবার উপায় নেই। বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম, বাংলানিউজ ডটকমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট ঘাটাঘাটি করে পাওয়া গেলো ইউনুস সাহেবের মহাজনী শোষণের বিভিন্ন তথ্য।
 ১৯৯৫ সালের মার্চ মাস। যশোর সদর উপজেলার মথুরাপুরের অসহায় মহিলা সাহেবা বিবি। অভাবের তাড়নায় ৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। কিস্তিও পরিশোধ করে যাচ্ছিলেন যথারীতি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করে সুদের কিস্তি পরিশোধ করে যেতে হয় তাঁকে। কয়েকটি কিস্তি অপরিশোধিত থেকে যায়। এরমধ্যে আবার সাহেবার ভ্যানচালক স্বামীও অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে দু’বেলা পেটের ভাতই ঝুটেনা অবস্থা। বাকি পড়ে যায় কয়েকটি কিস্তি।
ইউনুস সাহেবের বাহিনী এসে আক্রমণ করলো সাহেবাকে। ক’টা দিন সময় চাইলো তাঁরা। বললো, একটু দয়া করেন আমাদের। একটু সুস্থ হয়ে নিই। তারপর দিনরাত খেটে সব পাওনা মিটিয়ে দেবো। কাজ হলো না। গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রপ্রধান নূরজাহানের নেতৃত্বে ইউনুস বাহিনী ছিনিয়ে নিয়ে গেলো সাহেবার ছাগলটি। নিয়ে গেলো তাঁর স্বামীর, তাদের বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন ভ্যান গাড়িটিও।
চার\
পাঠকের মনে থাকবার কথা ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন আমেরিকার ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন। এসেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে। হিলারির জন্য নববধুর সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিলো ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার মশিহাটির ঋষিপাড়াকে। ৫ এপ্রিল ঋষিপাড়ায় হিলারির পদধূলি পড়ার পর ম্যাডামের সম্মানে এলাকার নামটাই পাল্টে ফেলা হয়। ঋষিপাড়ার নতুন নাম হয়-হিলারি পল্লি। সেদিন গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের এনে মুরিদ করানো হয় হিলারির কাছে। জামদানি শাড়ি পরে, মুড়িভাজা খেয়ে খেয়ে হিলারি নতুন মুরিদদের সবকও দেন। সবকটি একেবারে মূখস্ত করিয়ে দিয়ে যান। উচ্চারণ করান, যৌতুক আর দেবো না, বাল্য বিয়ে মানবো না, বদ্ধ ঘরে থাকবো না...। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অইদিন মশিহাটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে সাথী ও মুক্তি নামের যে দু’টি শিশু মেয়ে ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলো হিলারিকে, সেই মেয়ে দু’টিকেও বলি হতে হয়েছিলো বাল্য বিবাহের। ১৯৯৯ সালে ১২ বছরের সাথীর বিয়ে হয় হিরন্ময় নামের যুবকের সাথে। ১১ বছরের মুক্তির বিয়ে হয় মুক্তা নামের এক জুতার মিস্ত্রির সাথে। তাদের বিয়েতেও টেলিভিশন, সাইকেল, ঘড়ি ইত্যাদি দিতে হয় যৌতুক হিসেবে!
আরো দু:খজনক ঘটনা হলো, মুক্তি নামের সেই মেয়েটির বাবাও মুক্তি পাননি ইউনুসীয় থাবা থেকে। ইউনুস সাহেবের মহান একটি গুণ হলো, সুদের কিস্তির ব্যাপারে কারো সাথেই আপোস করেন না তিনি। ছাড়েননি মুক্তির বাবা মুকিন্দকেও। সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে যেয়ে বেচারা মুকিন্দকে ভিটেমাটি বিক্রি করে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিলো।
চাইলে এমন উদাহরণ দেয়া যাবে ভুরিভুরি। মাইক্রো ক্রেডিটের এই মহান জাদুকরের ঋণের পাতানো জালে ফেঁসে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বশ্রান্ত হতে হয় যশোরের সেই মশিহাটির লাবনী, শান্তি, শ্রাবণ, ভানুদাস, মিনারাণী, গীতা, সন্তুসহ নাম না জানা আরো কতো মানুষকে! মাত্র সাত হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মারা গিয়েছিলো দরিদ্র গৃহবধু পারুল। ইউনুসের গুণধর সৈনিকেরা লাশ আটকে দিয়েছিলো মেয়েটির। আগে ঋণের টাকা পরিশোধ, তারপর লাশ দাহ। শেষে পারুলের স্বামী কার্ত্তিক সুদে-আসলে টাকা পরিশোধের মুচলেকা দিয়ে লাশ সৎকারের সুযোগ পায়। মমতা নামের মেয়েটিকে কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বিক্রি করতে হয় ঘরের চালের টিন। মায়ারাণীকে বিক্রি করতে হয় ছাগল, গরু এমনকি বিয়ের আংটিটি পর্যন্ত।
 মোটকথা, অভাবের তাড়নায় পেটের জ্বালায় ইউনুস সাহেবের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের পর থেকে ঋণ গ্রহীতাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর আরাম হারাম হয়ে যেতো। সকল অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে হতো নিরবে। প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারতোনা কেউ। কারণ, কারো ঘাড়েই দ’ুটি মাথা ছিলো না।
 ঝিনাইদহের বিপ্ল¬বী কমিউনিস্ট নেতা মীর ইলিয়াছ হোসেন দীলিপ। গ্রামীণ ব্যাংকের কুকীর্তি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন ১৯৯৫ সালে। বইটির নাম ছিলো-‘গ্রামীণ ব্যাংক, মহাজনী শোষণের অভিনব হাতিয়ার’। দেখাগেলো কিছুদিনের মধ্যেই লাশ হয়ে গেছেন তিনি। ২০০০ সালের ১৫ই জানুয়ারি গুলি করে মেরে ফেলা হলো দীলিপকে!
পাঁচ \
৩৬% সুদের রমরমা ব্যবসা এদেশে কেবল ড. ইউনুসই করতে পেরেছেন। তারপরও তিনি মাইক্রো ক্রেডিটের জনক!  দেশের গরিবের ভাগ্য নিয়ে বিদেশের সাথে ভালোই ব্যবসা করতে পেরেছেন তিনি। আমাদের মাথা বিক্রি করে দাতাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগ করেছেন নিজের আত্মীয়-স্বজনের ফার্মে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানে। কিছু অবশ্য গরিবও পেয়েছে। তবে সাহায্য হিসেবে নয়, চড়া হারে সুদভিত্তিক ঋণ হিসেবে। সময়মত যে ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগ হলে খুলে নেয়া হয়েছে চালের টিন পর্যন্ত।
গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিলের অবস্থা খুবই শক্তিশালী। আবার বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান হাওয়ার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোনের ৩৫% মালিকানাও এই গ্রামীণ ব্যাংকের। তারপরও গরিবের রক্তচোষার সিরিঞ্জটি গুটিয়ে নেননি ড. ইউসুস। ‘রক্ত চাই আরো চাই’ নীতিই ছিলো তার সবচে’ প্রিয় নীতি। দারিদ্রের এই জাদুকর সময় সময় আমাদের মাথা বেঁচে বাইরে থেকে মোট কতো হাজার কোটি টাকা নিয়ে এসেছিলেন, সেই প্রশ্নটি আমাদের কোনো সরকার তাকে করেছিলো কি না, কে জানে!
ছয়\
আমাদের দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর মুখরোচক স্লোগান দিয়ে ইউনুস সাহেব বাইরে থেকে কতো বিলিয়ন ডলার নিয়ে এসেছেন, সেটার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের সরকারগুলোর কাছে নেই সম্ভবত! থাকলে তো ইউনুস সাহেবের তহবিল কারসাজির কাহিনী নরওয়ে থেকে আমাদের জানতে হতো না। স¤প্রতি নরওয়ে থেকে ইউনুস সাহেবের তহবিল কেলেংকারির খবর ফাঁস হবার পর একে একে থলের বিড়ালগুলোও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ইউনুসীয় কুকীর্তির আনবিক বোমাটি ফাটান ডেনমার্কের সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হাইনেমান। কট ইন মাইক্রো ডেট বা ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে শিরোণামে তৈরি প্রামাণ্য চিত্রটি বিশ্বের সামনে প্রকাশ করে দেয় নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনকেআর। ৩০ সভেম্বর ২০১০ ডকুমেন্টারি প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবার পর ইউনুস সাহেবের চেহারা থেকে ভালো মানুষের কৃত্রিম পর্দাটি সরে যায়। এদেশের দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করবার নাম করে নোরাডের কাছ থেকে সাহায্য হিসেবে আনা ৭শ কোটি ডলার তহবিল স্থানান্তরের তথ্য বেরিয়ে আসে। দেখা যায়, ইউনুস সাহেব টাকাগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের ফান্ড থেকে সরিয়ে ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামের উনার আরেকটি প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে রাখেন। ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যাবার পর এ ব্যপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কর বাঁচানো (ফাঁকি)’র জন্য তিনি এই সুকর্মটি করেছেন। রাষ্ট্রের কর ফাঁকি দেয়ার কাজ এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। ইউনুস সাহেবের ভাগ্য ভালো, এনবিআর তাকে অপমান করে টেনে-হেচরে আদালতে নিয়ে যায়নি। হয়তো পকেটে একটি নোবেল ছিলো বলে!
সাত \
লেখাটি শুরু করেছিলাম সুফিয়া খাতুনের গল্প দিয়ে। তাঁকে দিয়েই শেষ করি।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামের শিকদারপাড়ার দরিদ্র মহিলা সুফিয়া খাতুন। অভাবের সংসার তাঁর। দু’বেলা খাবার ঝুটেনা ঠিকমত। সময়টা ১৯৭৪ সাল। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত এক শিক্ষক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। কীভাবে কীভাবে জানি তার সাথে পরিচিত হয়ে যায় সুফিয়া। টাকা ধার চায় তার কাছে। ইউনুস তাঁকে ২০ টাকা ধার দেন। বলেদেন, সময়মত শোধ করতে পারলে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হবে। আরো বেশি পাবার আশায় সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধ করে দেয় সুফিয়া। এরপর তাঁকে দেয়া হয় ৫০০ টাকা।  একসাথে ৫শ টাকা হাতে পেয়ে সুফিয়া তো আনন্দে আতœহারা!  খুশির চোটে ব্যাপারটি চাউর করে দেয় সারা গ্রামে। আর ঠিক এমনটিই চাচ্ছিলেন গরিবের বন্ধু ইউনুস। দলে দলে অভাবি মহিলারা এসে ভিড় জমাতে থাকে ইউনুস সাহেবের পাশে। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট সুদের কারবার। 
 যে সুফিয়াকে ২০ টাকা ঋণ দিয়ে শুরু হয়েছিলো ড. ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা, সেই সুফিয়াদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আর হয়নি। ১৯৯৮ সালে পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় সুফিয়া। ইউনুস সাহেব কাছেও যাননি! গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে গরিব এই মহিলাটির কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করে। আজও সুফিয়ার ভাঙ্গা বাড়িতে তাঁর অসুস্থ দুই মেয়ে হালিমা (৫৫) এবং নূর নাহার (৫০) দিন কাটায় অনাহারে-অর্ধাহারে। পয়সার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা সুফিয়ার নাতনির। অথচ: এই সুফিয়াদেরকে কুড়ে ঘর থেকে বের করে এনে কীভাবে প্রাসাদের রাণী বানিয়ে দিয়েছেন, সেটার ৬ নম্বরী ডকুমেন্ট তৈরি করে বিশ্বব্যাপী সেটাকে ফলাও করে প্রকাশ করে ইউনুস সাহেব বাগিয়ে নেন শান্তিতে নোবেল ! সুফিয়ার পাশের বাড়ির মালিক দুবাই প্রবাসী একলোকের  দু’তলা বাড়িকে ইউনুস সাহেব প্রচার করতে থাকেন সুফিয়ার বাড়ি বলে! যে বাড়ি তিনি বানিয়ে দিয়েছেন!! জোচ্চরি আর কাকে বলে?
আট\
ইউনুস নামা, আগেই বলেছি, লিখে শেষ করা যাবে না। আজও কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে খুঁজলে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যারা ঘরহীন। প্ল¬াটফরমেই রাত কাটায় তারা। জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে এক সময় একটি ঘর ছিলো তাদের। ইউনুস সাহেবের ঋণ বাণিজ্যের জালে ফেঁসে গিয়ে কিস্তির প্যাঁচে পড়ে তাদের এই অবস্থা।  আজও ইউনুস সাহেবের গোদামে মরচে ধরা সেই টিনগুলো খুঁজলে পাওয়া যাবে যেগুলো তিনি খুলে এনেছিলেন গরিবের চাল থেকে। এদেশের হাজার হাজার মানুষকে স্থায়ীভাবে পথে নামানোর মহানায়ক গরিবের বন্ধু(?) ইউনুস দেরিতে হলেও ধরা খেয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুুব একটা  বাড়িয়ে বলেননি, “গরিবের রক্তচুষে খেলে ধরা তো খেতেই হয়।” এবারে বোধ’য় দালালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটা আমরা দেখতেই পারি ।

মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০১১

দারিদ্রের যাদুকর ! পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না

জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচার সুযোগ থাকলে ভদ্রলোক আপাতত তাই করতেন। একসময় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অংকের শিক্ষকতা করেছেন তিনি। অংক তাঁর প্রিয় বিষয়। অনেক জটিল অংক ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝিয়ে দিয়েছেন মিনারেল ওয়াটারের মতো। যদিও তাঁর ধারণা পৃ্থিবী জটিল কোনো নিয়মে চলেনা। জগতের সকল হিসাব শুধু যোগ আর বিয়োগ!

কিছুদিন শিক্ষকতা করবার পর বিরক্তি ধরে গেলো তাঁর। দুপুরে খেতে বসেন, মাথায় ঘুরঘুর করে পাটি গণিতের-একটি বানর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে প্রতি সেকেন্ডে তিন ফিট উপরে উঠে আবার পরের সেকেন্ডে পা ফসকে দুই ফিট নেমে যায়...ধরণের সমস্যা! অনেক ভেবেও তিনি বের করতে পারেননি তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে উঠার দরকারটা কী ছিলো! দেশে কি তেল ছাড়া বাঁশ ছিলোনা! কে তৈ্রি করেছে এমন অংক?


রাতে ঘুমোতে যান, মাথায় ভনভন করে বীজ গণিতের প্যাঁচ লাগানো সূত্রাবলি! রীতিমত হাফিয়ে উঠলেন তিনি। শিক্ষকতা ছেড়ে একটি বেসরকারি ফার্মে চাটার্ড একাউন্টেট হিসেবে জয়েন করলেন। এরপর দীর্ঘ ২৭ বছর অত্যন্ত সুনামের সাথেই কাজ করেছেন। অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করেছেন। মিলিয়েছেন অনেক না মিলা হিসাব। অথচ আজ...


আজ রিটায়ারমেন্টে এসে সহজ একটি হিসাব মিলাতে পারছেন না! অনেক ভেবেও যে হিসাবটি তিনি মিলাতে পারছেন না, তা হলো, এক জীবনে একজন মানুষের কতো টাকা দরকার? কতো

? কতো টাকা হয়ে গেলে মানুষ তৃপ্ত হয়ে যাবে। বলবে, ব্যাস, আমার আর দরকার নেই।

মোট কতো হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলে একজন মানুষ আর খোলা আকাশের নিচে থর থর করে কাঁপতে থাকা অসহায় ঘরনাই'দের ভাগ্যের কপালে থাবা বসাবে না। কতো টাকা হলে? কতো লাগে জীবনে একজন মানুষের??


২য় যে কারণে ভদ্রলোক আজ উদ্বিঘ্ন, সেটিও পাটি গণিতের অনুপাতের সূত্রের সাথে সম্পৃক্ত। তিনি তাঁর ৬২ বছরের জীবনে মোট দু'বার চালের টিন খুলে নেয়ার দৃশ্য দেখেছেন। তিনি হিসাব মিলাতে পারেন নি কোন টিন খোলায় কেমন লজ্জা? কার লজ্জা?


মাত্র বছর তিনেক আগের কথা। মেয়ের বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। জটলা দেখে দাঁড়ালেন একটু। দেখলেন টিন খোলার দৃশ্য...


হাজার হাজার কোটি টাকা আছে তাদের! সাদা কালো বেগুনি, সকল কালারের টাকাই আছে। হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গরীবের পা'চেটে কিছুদিনের জন্যে পাওয়া ক্ষমতা (কু)কাজে লাগিয়ে সেই গরীবের ভাগ্যের টিন চুরি করে লাগিয়ে রেখেছেন নিজের বাড়িতে বা ফ্যাক্টরিতে! সেনাবাহিনি অভিযান চালিয়ে ভাইজানের চাল থেকে টিনগুলো খুলে নিচ্ছে!


ভদ্রলোকের মাথায় তখন যে অংকটি ঘুরাঘুরি করছিলো, তা হলো, একটি টিন সমান কতোটি পরিবারের অভূক্ত থাকা??


তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন টিনচুর অই মালদার'রা চেহারায় ট্রেডমার্ক হাসি নিয়ে ক্যামেরার সামনে তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলে তৈ্রি ভিক্টরি সাইন করছে! ভদ্রলোকের বড়বেশি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো,টিন চুরি কোন পর্যায়ের বিজয়?? তিনি ভেবে পেলেন না লজ্জা তাদের কাছ থেকে কতো আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে!!!


চালের টিন খোলার আরেকটি ঘটনাও দেখেছেন তিনি। সেটা আরো ক'বছর আগে। সঠিক তারিখ মনে করতে পারলেন না। বয়স হয়েছে। স্মৃতি ক্ষমতাও বুড়ো হয়ে গেছে। আবছা আবছা মনে পড়লো...


সেদিন আকাশ ছিলো মেঘলা। ঘনঘন বিদ্যুত চমকাচ্ছে আকাশে। জানান দিচ্ছে বৃষ্টি মেঘমালা থেকে বিদায় নিয়ে তোমাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে দিয়েছে। যে কোনো সময় এসে পড়বে। তৈ্রি হও।

মানুষটি আর তৈ্রি হতে পারেনি। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো, তার স্ত্রী'র আহাজারি, বাচ্চাদের আর্তনাদ এবং তার নিজের সকল অনুনয়-বিনয় অগ্রাহ্য করে মহাজন খুলে নিয়ে যাচ্ছেন তার ঘরের টিনগুলো! মহাজন স্ব-উদ্যোগী হয়ে ৫২ সপ্তাহের প্যাঁচ লাগিয়ে ঋণ দিয়েছিলেন। কথা ছিলো প্রতি সপ্তাহে মহাজনের মুখে হাড্ডি তুলে দেয়া হবে। সাথে থাকবে গোশতও।

বাড়তি গোশতের যোগাড় করবার জন্যে সে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে একট গাভিও কিনেছিলো। ৩০ হাজার টাকা ঋণের বাকী ১৩ হাজার টাকা দিয়ে দুই বান্ডিল টিন এনে লাগিয়েছিলো ঘরের চালে।

দুর্ভাগ্য তার। গাভিটি হুট করে মারা গেলো!

এমনিতেই মানুষটি গরীব। এবারে আরো অসহায় হয়ে পড়লো। যাকে বলে উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলো'য়। তবুও সন্তানদের আধ পেট খাইয়ে পরিশোধ করে যাচ্ছিলো মহাজনের কিস্তি, সুদ সহ।


গত কয়েকটি কিস্তি সে দিতে পারেনি। মেঝ মেয়েটি কীভাবে কীভাবে জানি টাইফয়েড বাধিয়ে বসলো! ১৫ দিন মেয়েকে নিয়ে বাড়ি-হাসপাতাল করতে করতে অবস্থা একেবারে কাহিল!

মহাজনের পায়ে ধরে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো মানুষটি- আগামী সপ্তাহে সব বকেয়া মিটিয়ে দেব, চালের টিনগুলো খুলে নেবেন না। দয়া করুন।

মহাজন দয়া করেন নি। দয়া করার জন্য তার জন্ম হয়নি। অকথ্য গালিগালাজ করে টিনের সাথে ঘরের দরজা-জানালাগুলোও খুলে নিয়ে বীরের মতো চলে গেলেন। এমন বীরত্ব দেখানোর ক্ষমতা আছে বলেই না তিনি নোবেল বিজয়ী!


ভদলোক দেখলেন, মানুষটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূণ্য চালের দিকে। যে বৃষ্টি এতক্ষণ আকাশে ছিলো, সেটা তার চোখে চলে এসেছে! দু'চোখ দিয়ে অঝরে বইছে তার বিরামহীন ঝরণা। গাল বেয়ে বেয়ে লোনা জলগুলো গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এখন সে কোথায় যাবে?ছোট মেয়েটি সবেমাত্র সাত মাসে পড়েছে।


হঠাৎ ৭ ও ৯ বছরের ছেলে দু'টি দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মানুষটিকে। বিচিত্র কোন কারণে তাদের চোখে পানি নেই! বড়দের মতো শান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বললো,


কাঁদছো কেনো বাবা? আমাদের কথা ভেবে? কিন্তু এই দেখো, আমরা তো কাঁদছিনা! চালের টিন খুলে নিয়েছে তো কী হয়েছে! আমরা আছি না? আমরা তোমার সম্পদ না বাবা? কতো মানুষ তো গাছতলাতেই জীবন কাটিয়ে দেয়। তুমি তেমন একটা গাছ খুঁজে নিও, আমরা অখানেই থাকতে পারবো।


ছোট্ট বাচ্চাদের এমন কথা শুনে মানুষটি আর স্থীর থাকতে পারলোনা। কেঁদে উঠলো এবার শব্দ করে । সন্তান দু'টিকে জড়িয়ে নিলো বুকের সাথে। একটু আগেই তার মনে হচ্ছিলো,বেঁচে থাকার আর কোনো মানে হয়না! এখন আবার মনে হচ্ছে, এমন সন্তান যার আছে, সে বাপ আর ক'টা দিন বেঁচে থাকলে মন্দ হয় না। সকল কষ্ট জয় করে তার ঠোঁটের কোণায় উদয় হল এক চিলতে হাসি। তখনো মানুষটির চোখে টল টল করছে পানি!


ভদ্রলোক চলে এলেন অখান থেকে। আর আসতে আসতে মনে মনে বললেন, এই চোখের পানিগুলো বেকার যাবেনা। কাজে লাগবেই। গরীবের চোখের পানির ক্ষমতা অনেক বেশি। হাজার নোবেলের ক্ষমতা থেকে অবশ্যই বেশি। এই কষ্টের পানির ফোটাগুলো অপমানের তিলক হয়ে তার কপালে বসবেই। বেইজ্জতির মালা হয়ে গলায় ঝুলবেই।

আমি জানিনা ভদ্রলোক আজ কোথায়? তিনি কি দেখছেন নোবেলওয়ালার পরিনতি!!!!