সুফিয়া খাতুন মারা গেছেন বারো বছর আগে, ১৯৯৮ সালে। সহায়-সম্ভলহীন এই মানুষটি মারা যাবার পর কাফন-দাফনের পয়সাও ছিলোনা পরিবারের কাছে। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে তাঁর দাফনের ব্যবস্থা করে। অথচ:এই সুফিয়া আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। একজন স্বচ্ছল-স্বাবলম্ভি মহিলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। আমি চট্রগ্রামের জোবরা গ্রামের শিকদারপাড়ার সেই সুফিয়ার কথাই বলছি, আজ থেকে ৩৬ বছর আগে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত এক শিক্ষক, মুহাম্মদ ইউনুস নামের এক ব্যক্তি যে মেয়েটিকে মাত্র ২০ টাকা ঋণ দিয়ে শুরু করেছিলেন সুদের রমরমা বিজনেস, ক্ষুদ্র ঋণের মহাজনী ব্যবসা।
সময় গড়িয়ে যায়। সুফিয়া সুফিয়াই থেকে যান। তাঁর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আর হয় না। অনাহারে-অর্ধাহারে এবং বিনা টিকিৎসায় একদিন মারা যান সুফিয়া। আর সুফিয়াদের মার্কেটিং করে অখ্যাত সেই শিক্ষক হয়ে যান বিখ্যাত। অশান্তিতে ছটপট করতে করতে মারা যেতে থাকে সুফিয়ারা। বিখ্যাত সেই মহাজন পেয়ে যান শান্তির নোবেল!
সুফিয়াদের কথায় পরে আসছি। তার আগে কিছু খুচরো কথা।
আমাদের দেশে ‘ভাবমূর্তি’ নামের অতি স্পর্শকাতর একটি বস্তু আছে। এটি থাকে কচুপাতার উপরে। সবসময় টলমল করতে থাকে। কখন পড়ে যায় কখন পড়ে যায় অবস্থা! এক শ্রেণীর মানুষও আছেন এদেশে। যাদের কেতাবি নাম সুশীল শ্রেণী। তাদের সকল কর্মকাণ্ড এই কচুপাতায় থাকা বস্তুকে ঘিরেই পরিচালিত হয়। সকাল-সন্ধ্যা তারা মত্ত থাকেন ভাবমূর্তি বন্দনায়। কচুগাছটির গোড়ায় নিয়মিত পানি দিতে নসিহত করে বেড়ান অথচ নিজেরা ভুলেও এই কাজটি কখনো করেন না।
ড.ইউনুসের পাপ বালেগ হয়ে যাবার পর তাকে অপসারণ করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে। বিধি অনুযায়ী ইউনুস ষাট বছর বয়স পর্যন্ত এই পদে থাকবার যোগ্যতা রাখেন। হযরতের বর্তমান বয়স একাত্তর। ব্যাপারটি তাকে জানানোও হয়েছিলো বারবার। বলা হয়েছিলো আপনি সম্মানী মানুষ। সম্মান নিয়ে সরে পড়–ন। তিনি সরেননি। লাখো গরিবের চোখের পানি ঝরেছে যার কারণে, অসংখ্য অসহায়ের বুকফাঁটা অভিশাপের মালা ঝুলে রয়েছে যার গলায়, সম্মান অবশ্য তার ভাগ্যে ঝুটার কথাও নয়।
সিদ্ধান্তটি মেনে নিলেন না ইউনুস। গেলেন উচ্চ আদালতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আদালতকে তিনি বললেন, আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। আমি আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে চাই। ওরা থাকতে দিতে রাজি হচ্ছে না। বলে দেয়া হোক আমাকে যেনো থাকতে দেয়া হয়।
মহামান্য আদালত ফরিয়াদটি তিনদিন ধরে শুনলেন। কাগজপত্র দেখলেন। সবকথা বিচার-বিশ্লেষণ করলেন। তারপর বললেন, ইউনুস সাহেব! কিছু মনে করবেন না। আপনাকে অব্যহতি দেয়ার আদেশটি সঠিকভাবেই দেয়া হয়েছে। আপনি অনেকদিন বে-আইনিভাবে পদে ছিলেন। আর না থাকাই ভালো। আইনের চোখে সবাই সমান।
এই যখন অবস্থা, তখন আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ করছি ইউনুস ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন সুশীল শ্রেণীর স্বঘোষিত ঠিকাদাররা। ইউনুসের মতো এতো বড়মাপের একজন বুজুর্গকে যে অপমান করা হয়েছে এবং এতেকরে দেশের ভাবমূর্তি যে একেবারেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে চিৎকার করে বলতে শুরু করেছেন তাঁরা। পশ্চিমপাড়ার বন্ধুদের নজর কাড়ার জন্য হোক আর দেশি-বিদেশি মক্কেলদের নিমকহালালীর জন্যই হোক, ইউনুসের জন্য তাদের দরদ সাংঘাতিকভাবে উতলে উঠেছে! একচোখা এই বুদ্ধির ফেরিওয়ালাদের চোখের সামনে একবারও ভেসে উঠছেনা ইউনুসের প্যাঁচে পড়ে পথে নামা এদেশের অসহায় মানুষের ফুটো হয়ে যাওয়া মুখগুলো। তাদের চোখে পড়ছেনা ইউনুস সাহেবের অন্যায় আস্থাভাজন হতে না পারায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চাকরি খোয়ানো সাড়ে ৮ হাজার মানুষের বিধ্বস্ত চেহারাগুলো। ইউনুস সাহেবের সম্মান আছে, গরিবের বুঝি সম্মান থাকতে নেই? হায়রে বুদ্ধিজীবি! মূর্খতাই তবে কেনো শ্রেয় হবে না?
ইউনুস সাহেবের বিদেশি বন্ধুরা তাকে নিয়ে পেরেশান। মরিয়াটিদের দৌড়-ঝাপ দেখে মনে হচ্ছে বর্তমানে কাজ তাদের একটাই, যে কোনো উপায়ে তাদের বন্ধুকে যথাস্থানে জিন্দা রাখা। আর এটা করতে গিয়ে সকল নিয়ম-নীতি লঙ্গন করে কুটনৈতিক শিষ্টাচার বেমালুম ভুলে গিয়ে এমনভাবে কথা বলে চলেছেন তাঁরা, যেভাবে বলবার কোনো অধিকারই তাদের নেই। আমার দেশের তথাকথিত সুশীলরা একটিবারও বলতে পারছেন না গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান। ড.ইউনুসও একজন বাঙালি। সুতরাং এটি আমাদের ঘরোয়া বিষয়। এখানে আমরা আমাদের আইনে যা খুশি, তাই করবো। তোমরা কথা বলার কে?
দুই\
ড. ইউনুসকে অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না দেয়ায় মারাতœক গোস্বা করেছে আমেরিকা। খুব ঘনঘন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা টাইপ শব্দ কচলাচ্ছে তারা আজকাল। আমরা সাধারণ মানুষ ভেবে পাচ্ছিনা এখানে তাদের এতো পেরেশান হবার কারণ কী? তারা কেনো বুঝতে চাইবেনা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে যে কোনো সিদ্ধান্তই আমরা নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রেসক্রিপশনের কোনো দরকার নেই। হিলারি ক্লিনটন বা ক্লিনটন ফ্যামিলির সাথে ইউনুস সাহেবের সু-সম্পর্ক থাকতে পারে। ইউনুস সাহেব কখনো কোনো মুচলেকা-টুচলেকা দিয়ে থাকলে তিনি হয়তো তাদের কাছে ধরা থাকতে পারেন। কিন্তু দেশের ষোল কোটি মানুষের তো কোনো দায় নেই কারো কাছে।
আমার খুব মনে পড়ছে ৩৯ বছর আগের কথা। মার্চ মাস চলছে। আজ থেকে ৩৯ বছর আগে এমনি এক মার্চের ২৬ তারিখ আমরা শুরু করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আমেরিকা সেদিনও আমাদের বিরোধীতা করেছিলো। জালিমের পক্ষেই থাকে তাদের অবস্থান। পশ্চিম পাকিস্তানি কুকুরগুলো যখন পাগল হয়ে গিয়েছিলো, পাখির মতো গুলিকরে মারছিলো আমার ভাইকে, তখনও আমেরিকা ছিলো তাদের পক্ষে। এমনকি আমাদের মারবার জন্য নৌ-বহর পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এরা স্বাধীনতার আগেও আমাদের মেনে নেয়নি, পরেও না। সদ্য-স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত আমার দেশটি নিয়ে সেদিন তারা কম নাক সিটকায়নি। হেনরি কিসিন্জাররা আমার দেশকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো। বলতো, বটমলেস বাস্কেট, তলাবিহীন ঝুড়ি!
সেই আমেরিকা আজ আমার দেশের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার নিয়ে শুধু নাকই গলাচ্ছে না, রীতিমতো মাথাটাই ঢুকিয়ে দিতে চাইছে! একজন ইউনুসের জন্য এতো মায়া কেনো তাদের? কারণটা কী?
নিজ দেশের হাজার হাজার মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়া একজন মানুষ পেয়ে যান শান্তিতে নোবেল! রাজনীতিবিদ না হয়েও দম্ভের সাথে ঘোষণা করতে পারেন, দুই নেত্রীকে একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা দরকার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় যখন দেশে সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, তখন কোন খুটির জোরে ইউনুস সাহেব নাগরিক শক্তি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের পায়তারা করতে পারলেন, মাইনাস টু থিওরি বাজারজাত করণের ঠিকাদারী... এই ধরণের বিষয়গুলোকে সামনে রাখলে এবং নির্মোহ পর্যালোচনা করতে পারলে কারণটা স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা। আমেরিকার বড় ইচ্ছে ইউনুস সাহেবের নামটি পরিবর্তন করে নতুন একটি নাম রাখা। সেই নামটি হবে হামিদ কারজাঈ! এটা কি আমার দেশের তথাকথিত সেই সুশীল শ্রেণী বুঝতে পারছেন? না পারলে তাদেরকে আর লেখাপড়া করতে বলেছিলো কে?
অনেকের কাছেই একটি ব্যাপার স্পষ্ট নয়। শান্তিতে নোবেল পাবার জন্য ড. ইউনুসের ব্যাকগ্রাউন্ডটা কী ছিলো? সুদের কারবারি হলেও তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। তাকে অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া হলেও না হয় একটা কথা ছিলো। দেয়া হলো শান্তিতে! ঘটনা কী?
স¤প্রতি আমি একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি। সে অলোকে একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছি। সেটা এরকম,
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ মেহনতে ৮ টি এনজিও’র মাধ্যমে পার্বত্য চট্রগ্রামের চারটি জেলায় মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বি মানুষকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করার কর্মকাণ্ড বেশ জোরেসুরেই চলছে। শতশত কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। সস্থির কথা হচ্ছে বিষয়টি আমাদের সরকারের নজরেও এসেছে। উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত চলছে। আমাদের স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সুবহান জানিয়েছেন,পার্বত্য অঞ্চলের এনজিওগুলোর কাজ সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রতারকদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আর সম্ভবত পার্বত্য চট্রগ্রামের চার জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের মানুষকে ছলে বলে কলে কৌশলে ধর্মান্তরিত করা এবং মওকা বুঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গোষ্টীকে উসকে দিয়ে দেশের অখণ্ডতার পাঁজরে আঘাত বসানো এবং অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে, এই কাজটির গোপন কোনো কন্টাক্ট ইউনুস সাহেবকে দেয়া হয়ে থাকলে শান্তিতে নোবেলের সার্থকতা প্রশ্নাতীত। কাজটি ঠান্ডা মাথায় এবং শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে!
তিন \
প্রসঙ্গক্রমে আবার চলে আসে সুশীল শ্রেণীর কথা। ড. ইউনুসের জন্য তাদের অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে! হতেই পারে। নুন, দেশি হোক বা বিদেশি, খেলে তো গুণ গাইতেই হয়। ড. ইউনুসের মতো একজন ধোয়া তুলসির পাতাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করার কারণে দেশের ভাবমূর্তি কত হাত মাটির নিচে চলে গেছে, সেটা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত! দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার এই মিছিলে শরীক হয়েছেন দেশনেত্রীও, সদলবলে। ইউনুস সাহেবের পক্ষে বিবৃতির ফুলঝুরি বর্ষিত হচ্ছে বেগম জিয়ার মুখ থেকে। এই ইস্যুতে আবার হরতাল-টরতাল ডেকে বসেন কি না-কে জানে!
বিএনপি দেশের প্রধান বিরোধীদল। বিরোধীদলের মানে কি সরকার যা করবে, সব কাজেরই বিরোধীতা করা? ড. ইউনুসের ঋণ বাণিজ্যের পাল্লায় পড়ে সর্বশ্রান্ত হওয়া এদেশের হাজার হাজার মানুষের দুর্গতি বেগম জিয়াকে বিচলিত করলো না! ইউনুস সাহেবের কল্যাণে বাড়িঘর বিক্রি করে খোলা আকাশের নিচে বাস করতে থাকা এদেশের অসংখ্য মানুষের দুর্দশা নেত্রীকে কষ্ট দিলো না! তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইউনুস সাহেবের ভাবমূর্তি নিয়ে! হায়রে বাংলাদেশের রাজনীতি!!
বেগম খালেদা জিয়া এবং ড. ইউনুসের জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামা মুরব্বীরা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের আমলনামার কথা ভুলে গেছেন। সমস্যা নেই। আমরা ছোট’রা আছি কী জন্যে! ইউনুস সাহেবের সুকীর্তি’র অতি সামান্য কিছু চিত্র সামনে নিয়ে আসলে তাদের মনে পড়বে ইউনুস কতো মহৎ!
ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা (নাকি প্রভোক্তা), দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা দেয়া ড. মুহাম্মদ ইউনুস নিজেই হয়ে যান দারিদ্রের বহুরূপী এক জাদুকর! এই ভদ্রলোকের সুদভিত্তিক আমলনামা এতই বড় ও বিস্তৃত যে, জেনে ও লিখে শেষ করবার উপায় নেই। বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম, বাংলানিউজ ডটকমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট ঘাটাঘাটি করে পাওয়া গেলো ইউনুস সাহেবের মহাজনী শোষণের বিভিন্ন তথ্য।
১৯৯৫ সালের মার্চ মাস। যশোর সদর উপজেলার মথুরাপুরের অসহায় মহিলা সাহেবা বিবি। অভাবের তাড়নায় ৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। কিস্তিও পরিশোধ করে যাচ্ছিলেন যথারীতি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করে সুদের কিস্তি পরিশোধ করে যেতে হয় তাঁকে। কয়েকটি কিস্তি অপরিশোধিত থেকে যায়। এরমধ্যে আবার সাহেবার ভ্যানচালক স্বামীও অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে দু’বেলা পেটের ভাতই ঝুটেনা অবস্থা। বাকি পড়ে যায় কয়েকটি কিস্তি।
ইউনুস সাহেবের বাহিনী এসে আক্রমণ করলো সাহেবাকে। ক’টা দিন সময় চাইলো তাঁরা। বললো, একটু দয়া করেন আমাদের। একটু সুস্থ হয়ে নিই। তারপর দিনরাত খেটে সব পাওনা মিটিয়ে দেবো। কাজ হলো না। গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রপ্রধান নূরজাহানের নেতৃত্বে ইউনুস বাহিনী ছিনিয়ে নিয়ে গেলো সাহেবার ছাগলটি। নিয়ে গেলো তাঁর স্বামীর, তাদের বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন ভ্যান গাড়িটিও।
চার\
পাঠকের মনে থাকবার কথা ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন আমেরিকার ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন। এসেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে। হিলারির জন্য নববধুর সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিলো ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার মশিহাটির ঋষিপাড়াকে। ৫ এপ্রিল ঋষিপাড়ায় হিলারির পদধূলি পড়ার পর ম্যাডামের সম্মানে এলাকার নামটাই পাল্টে ফেলা হয়। ঋষিপাড়ার নতুন নাম হয়-হিলারি পল্লি। সেদিন গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের এনে মুরিদ করানো হয় হিলারির কাছে। জামদানি শাড়ি পরে, মুড়িভাজা খেয়ে খেয়ে হিলারি নতুন মুরিদদের সবকও দেন। সবকটি একেবারে মূখস্ত করিয়ে দিয়ে যান। উচ্চারণ করান, যৌতুক আর দেবো না, বাল্য বিয়ে মানবো না, বদ্ধ ঘরে থাকবো না...। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অইদিন মশিহাটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে সাথী ও মুক্তি নামের যে দু’টি শিশু মেয়ে ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলো হিলারিকে, সেই মেয়ে দু’টিকেও বলি হতে হয়েছিলো বাল্য বিবাহের। ১৯৯৯ সালে ১২ বছরের সাথীর বিয়ে হয় হিরন্ময় নামের যুবকের সাথে। ১১ বছরের মুক্তির বিয়ে হয় মুক্তা নামের এক জুতার মিস্ত্রির সাথে। তাদের বিয়েতেও টেলিভিশন, সাইকেল, ঘড়ি ইত্যাদি দিতে হয় যৌতুক হিসেবে!
আরো দু:খজনক ঘটনা হলো, মুক্তি নামের সেই মেয়েটির বাবাও মুক্তি পাননি ইউনুসীয় থাবা থেকে। ইউনুস সাহেবের মহান একটি গুণ হলো, সুদের কিস্তির ব্যাপারে কারো সাথেই আপোস করেন না তিনি। ছাড়েননি মুক্তির বাবা মুকিন্দকেও। সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে যেয়ে বেচারা মুকিন্দকে ভিটেমাটি বিক্রি করে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিলো।
চাইলে এমন উদাহরণ দেয়া যাবে ভুরিভুরি। মাইক্রো ক্রেডিটের এই মহান জাদুকরের ঋণের পাতানো জালে ফেঁসে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বশ্রান্ত হতে হয় যশোরের সেই মশিহাটির লাবনী, শান্তি, শ্রাবণ, ভানুদাস, মিনারাণী, গীতা, সন্তুসহ নাম না জানা আরো কতো মানুষকে! মাত্র সাত হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মারা গিয়েছিলো দরিদ্র গৃহবধু পারুল। ইউনুসের গুণধর সৈনিকেরা লাশ আটকে দিয়েছিলো মেয়েটির। আগে ঋণের টাকা পরিশোধ, তারপর লাশ দাহ। শেষে পারুলের স্বামী কার্ত্তিক সুদে-আসলে টাকা পরিশোধের মুচলেকা দিয়ে লাশ সৎকারের সুযোগ পায়। মমতা নামের মেয়েটিকে কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বিক্রি করতে হয় ঘরের চালের টিন। মায়ারাণীকে বিক্রি করতে হয় ছাগল, গরু এমনকি বিয়ের আংটিটি পর্যন্ত।
মোটকথা, অভাবের তাড়নায় পেটের জ্বালায় ইউনুস সাহেবের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের পর থেকে ঋণ গ্রহীতাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর আরাম হারাম হয়ে যেতো। সকল অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে হতো নিরবে। প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারতোনা কেউ। কারণ, কারো ঘাড়েই দ’ুটি মাথা ছিলো না।
ঝিনাইদহের বিপ্ল¬বী কমিউনিস্ট নেতা মীর ইলিয়াছ হোসেন দীলিপ। গ্রামীণ ব্যাংকের কুকীর্তি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন ১৯৯৫ সালে। বইটির নাম ছিলো-‘গ্রামীণ ব্যাংক, মহাজনী শোষণের অভিনব হাতিয়ার’। দেখাগেলো কিছুদিনের মধ্যেই লাশ হয়ে গেছেন তিনি। ২০০০ সালের ১৫ই জানুয়ারি গুলি করে মেরে ফেলা হলো দীলিপকে!
পাঁচ \
৩৬% সুদের রমরমা ব্যবসা এদেশে কেবল ড. ইউনুসই করতে পেরেছেন। তারপরও তিনি মাইক্রো ক্রেডিটের জনক! দেশের গরিবের ভাগ্য নিয়ে বিদেশের সাথে ভালোই ব্যবসা করতে পেরেছেন তিনি। আমাদের মাথা বিক্রি করে দাতাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগ করেছেন নিজের আত্মীয়-স্বজনের ফার্মে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানে। কিছু অবশ্য গরিবও পেয়েছে। তবে সাহায্য হিসেবে নয়, চড়া হারে সুদভিত্তিক ঋণ হিসেবে। সময়মত যে ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগ হলে খুলে নেয়া হয়েছে চালের টিন পর্যন্ত।
গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিলের অবস্থা খুবই শক্তিশালী। আবার বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান হাওয়ার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোনের ৩৫% মালিকানাও এই গ্রামীণ ব্যাংকের। তারপরও গরিবের রক্তচোষার সিরিঞ্জটি গুটিয়ে নেননি ড. ইউসুস। ‘রক্ত চাই আরো চাই’ নীতিই ছিলো তার সবচে’ প্রিয় নীতি। দারিদ্রের এই জাদুকর সময় সময় আমাদের মাথা বেঁচে বাইরে থেকে মোট কতো হাজার কোটি টাকা নিয়ে এসেছিলেন, সেই প্রশ্নটি আমাদের কোনো সরকার তাকে করেছিলো কি না, কে জানে!
ছয়\
আমাদের দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর মুখরোচক স্লোগান দিয়ে ইউনুস সাহেব বাইরে থেকে কতো বিলিয়ন ডলার নিয়ে এসেছেন, সেটার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের সরকারগুলোর কাছে নেই সম্ভবত! থাকলে তো ইউনুস সাহেবের তহবিল কারসাজির কাহিনী নরওয়ে থেকে আমাদের জানতে হতো না। স¤প্রতি নরওয়ে থেকে ইউনুস সাহেবের তহবিল কেলেংকারির খবর ফাঁস হবার পর একে একে থলের বিড়ালগুলোও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ইউনুসীয় কুকীর্তির আনবিক বোমাটি ফাটান ডেনমার্কের সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হাইনেমান। কট ইন মাইক্রো ডেট বা ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে শিরোণামে তৈরি প্রামাণ্য চিত্রটি বিশ্বের সামনে প্রকাশ করে দেয় নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনকেআর। ৩০ সভেম্বর ২০১০ ডকুমেন্টারি প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবার পর ইউনুস সাহেবের চেহারা থেকে ভালো মানুষের কৃত্রিম পর্দাটি সরে যায়। এদেশের দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করবার নাম করে নোরাডের কাছ থেকে সাহায্য হিসেবে আনা ৭শ কোটি ডলার তহবিল স্থানান্তরের তথ্য বেরিয়ে আসে। দেখা যায়, ইউনুস সাহেব টাকাগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের ফান্ড থেকে সরিয়ে ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামের উনার আরেকটি প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে রাখেন। ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যাবার পর এ ব্যপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কর বাঁচানো (ফাঁকি)’র জন্য তিনি এই সুকর্মটি করেছেন। রাষ্ট্রের কর ফাঁকি দেয়ার কাজ এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। ইউনুস সাহেবের ভাগ্য ভালো, এনবিআর তাকে অপমান করে টেনে-হেচরে আদালতে নিয়ে যায়নি। হয়তো পকেটে একটি নোবেল ছিলো বলে!
সাত \
লেখাটি শুরু করেছিলাম সুফিয়া খাতুনের গল্প দিয়ে। তাঁকে দিয়েই শেষ করি।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামের শিকদারপাড়ার দরিদ্র মহিলা সুফিয়া খাতুন। অভাবের সংসার তাঁর। দু’বেলা খাবার ঝুটেনা ঠিকমত। সময়টা ১৯৭৪ সাল। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত এক শিক্ষক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। কীভাবে কীভাবে জানি তার সাথে পরিচিত হয়ে যায় সুফিয়া। টাকা ধার চায় তার কাছে। ইউনুস তাঁকে ২০ টাকা ধার দেন। বলেদেন, সময়মত শোধ করতে পারলে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হবে। আরো বেশি পাবার আশায় সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধ করে দেয় সুফিয়া। এরপর তাঁকে দেয়া হয় ৫০০ টাকা। একসাথে ৫শ টাকা হাতে পেয়ে সুফিয়া তো আনন্দে আতœহারা! খুশির চোটে ব্যাপারটি চাউর করে দেয় সারা গ্রামে। আর ঠিক এমনটিই চাচ্ছিলেন গরিবের বন্ধু ইউনুস। দলে দলে অভাবি মহিলারা এসে ভিড় জমাতে থাকে ইউনুস সাহেবের পাশে। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট সুদের কারবার।
যে সুফিয়াকে ২০ টাকা ঋণ দিয়ে শুরু হয়েছিলো ড. ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা, সেই সুফিয়াদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আর হয়নি। ১৯৯৮ সালে পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় সুফিয়া। ইউনুস সাহেব কাছেও যাননি! গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে গরিব এই মহিলাটির কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করে। আজও সুফিয়ার ভাঙ্গা বাড়িতে তাঁর অসুস্থ দুই মেয়ে হালিমা (৫৫) এবং নূর নাহার (৫০) দিন কাটায় অনাহারে-অর্ধাহারে। পয়সার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা সুফিয়ার নাতনির। অথচ: এই সুফিয়াদেরকে কুড়ে ঘর থেকে বের করে এনে কীভাবে প্রাসাদের রাণী বানিয়ে দিয়েছেন, সেটার ৬ নম্বরী ডকুমেন্ট তৈরি করে বিশ্বব্যাপী সেটাকে ফলাও করে প্রকাশ করে ইউনুস সাহেব বাগিয়ে নেন শান্তিতে নোবেল ! সুফিয়ার পাশের বাড়ির মালিক দুবাই প্রবাসী একলোকের দু’তলা বাড়িকে ইউনুস সাহেব প্রচার করতে থাকেন সুফিয়ার বাড়ি বলে! যে বাড়ি তিনি বানিয়ে দিয়েছেন!! জোচ্চরি আর কাকে বলে?
আট\
ইউনুস নামা, আগেই বলেছি, লিখে শেষ করা যাবে না। আজও কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে খুঁজলে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যারা ঘরহীন। প্ল¬াটফরমেই রাত কাটায় তারা। জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে এক সময় একটি ঘর ছিলো তাদের। ইউনুস সাহেবের ঋণ বাণিজ্যের জালে ফেঁসে গিয়ে কিস্তির প্যাঁচে পড়ে তাদের এই অবস্থা। আজও ইউনুস সাহেবের গোদামে মরচে ধরা সেই টিনগুলো খুঁজলে পাওয়া যাবে যেগুলো তিনি খুলে এনেছিলেন গরিবের চাল থেকে। এদেশের হাজার হাজার মানুষকে স্থায়ীভাবে পথে নামানোর মহানায়ক গরিবের বন্ধু(?) ইউনুস দেরিতে হলেও ধরা খেয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুুব একটা বাড়িয়ে বলেননি, “গরিবের রক্তচুষে খেলে ধরা তো খেতেই হয়।” এবারে বোধ’য় দালালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটা আমরা দেখতেই পারি ।