রক্তে মাখামাখি হয়ে কাত্রাচ্ছে ছেলেটি। একটি গুলি তার বাম পাজরকে ফুটোকরে বেরিয়ে গেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সে তার ডান হাত দিয়ে আক্রান্ত স্থানটি চেপে ধরে আছে সজোরে। ঘটনাটি ঘটছে পরিস্কার দিনের আলোয়। অনেক লোকের সামনে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ এগিয়ে আসছে না! ছেলেটি মা মা বলে চিৎকার করছে।
কোত্থেকে জানি খবর পেয়ে ছেলেটির মা ছুটে এসেছেন। তিনি চেষ্টা করছেন ছেলেটির কাছে যেতে। পারছেন না। পা নাড়াতে পারছেন না। হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করছেন আদরের সন্তানটিকে কোলে নিতে একটু ছুঁয়ে দেখতে। তাও পারছেন না। শরীর জমে গেছে ে যেনো। ছেলেটির মা মা আওয়াজটি আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। কাঁদছে ছেলেটি। কাঁদছেন মা-ও। সন্তানটি তাঁর চোখের সামনেই মারা যাচ্ছে অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না...।
হঠাৎ মহিলা লক্ষ্য করলেন ঘামছেন তিনি। সারা শরীর ভিজে স্যাঁতসেতে হয়ে গেছে। প্রচন্ড তৃষ্ণা অনুভব করলেন। গলা শুকিয়ে গেছে। তালু পর্যন্ত। পরপর তিনগ্লাস পানি পান করলেন। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকলেন তিনি। সবকিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে। এলোমেলো লাগছে। চোখ বন্ধ করে পুরো অবস্থাটা পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করছেন তিনি। তিনি তাহলে স্বপ্ন দেখছিলেন! নিশ্চিত হবার জন্য গায়ে চিমটি কাটলেন সজোরে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেন। উফ জাতীয় একটি শব্দ বেরিয়ে আসলো তার মুখ দিয়ে। সঙ্গে একটি স্বস্থির নিঃশ্বাসও। তাহলে তিনি স্বপ্নই দেখছিলেন! স্বপ্নের সেই ভয়ালো আঙিনা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এর মানে তার ছেলেটিরও তাহলে কিছু হয়নি।
তবুও মনকে শান্ত করতে পারলেন না। মায়ের মন তো। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল ফোন বের করে ফোন করলেন ছেলেকে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন-
হ্যা -----লো।
হ্যালো মা! এত রাতে? কী ব্যাপার, সব ঠিক আছে তো?
তুই কেমন আছিস বাবা?
আমি ভাল আছি। কেনো ফোন করেছে বলো?
সত্যি বলছিস তো তুই? ভালো আছিস?
আহ্ হা মা! কী হয়েছে বলো তো?
আচ্ছা তোর শরীর কেমন?
আচ্ছা মা, তুমি আবারও আমাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছো? সত্যি করে বলো তো ঘটনা কী?
না, বাবা, কিচ্ছু না। তুই ঘুমা। ভালো থাকিস।
ফোনটা রেখে তিনি অনুভব করলেন বুক থেকে যেন শক্ত একটি পাথর নেমে গেছে। সাথে সাথেই হাত তুললেন উপরের দিকে.... হে আল্লাহ আমার এই দুঃস্বপ্ন যেন কখনো সত্যি না হয়। আমার ছেলেটির লেখাপড়া করা হোক আর না হোক, তাকে যেন লাশ হয়ে আমার কাছে ফিরে আসতে না হয়...
পাঠক আমি খুব দুঃখিত। আমি জানি গল্প বলার আদর্শ জায়গা এটি না। আর আমাকে গল্প লিখতেও বলা হয়নি। আমি লিখবো শিক্ষাঙ্গণের অস্তিরতা নিয়ে । একটু ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে আমি সেই চেষ্টাই করছি।
এক বাবা, নুন আনতে পানতা ফুরোয় টাইপ আর্থিক অবস্থা যার, মেয়েকে ভার্সিটিতে পাঠিয়ে অস্থির হয়ে থাকেন। অজানা শংকায় বারবার কেঁপে উঠে তার দুর্বল মনটি। তিনি শুনেছেন এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্ষণের সেঞ্চুরী উৎসবও ঘটা করে পালন করা হয়! তার মেয়েটি আবার জাহাঙ্গীর নগরেই পড়ছে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। কখনো ট্রাফিক জ্যামের কারণে মেয়ের বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলে ভয়ংকর সব চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বারবার তার মনে হতে থাকে তার নিষ্পাপ মেয়েটি কোনো মানিকের লোভের শিকারে পরিণত হয়ে যায়নি তো? জোর করে ওর জরায়ূতে পুতে দেয়া হচ্ছেনা তো কোনো লা ওয়ারিসের বীজ!
দুই \
প্রেক্ষাপট যদি হয় বাংলাদেশ, তাহলে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড নাকি মৃত্যুদন্ড, রীতিমত গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কে বলেছিলেন কথাটি? ‘শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড’ আজ তাকে আমার কাছে পেতে ইচ্ছে করছে খুব। তাহলে বলতাম, কিছু মনে করবেন না জনাব, আপনার মেরুদন্ডকে আমরা মৃত্যুদন্ড বানিয়ে ফেলেছি। যত দোষ অই ব্যাটা ডারউইনের। বিবর্তনবাদের ভূত মানুষের মাহফিলে পাত্তা না পেয়ে শেষমেস শিক্ষাক্ষেত্রের অতি নিরীহ এই শব্দটির ঘাড়েই আসর করেছে। সম্ভবত!
কেনো বলছি একথা? শিক্ষাকে আমি জাতির মৃত্যুদন্ড বলছি কেনো? আশা করি এই প্রশ্ন আমাকে কেউ করতে চাইবেন না। জবাব যে সকলেরই জানা আছে। আজকাল আমাদের কলেজ/ভার্সিটিগুলোর যে অবস্থা, তাতে ডিগ্রি নিয়ে ফেরারচে’ লাশ হয়ে ফেরাটাই তুলনামূলক সহজ হয়ে গেছে। এক মা তার ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে একটি রাতও কি শান্তিতে ঘুমোতে পারেন? এক বাবার তার মেয়ের চিন্তায় কোনো কাজই কি ঠিক মতো করা হয়? সন্তানকে জাতির মেরুদন্ড হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে কি নিজেদের মেরুদন্ডই কুঁজো করে ফেলছেন না? অই বাবা, অই মা, অনেক ভেবেও তারা বের করতে পারে না পড়ালেখার সাথে মারামারির সম্পর্কটা কিভাবে তৈরি হলো!
নষ্ট রাজনীতিই এ জন্য দায়ী। গরীব এই লোকগুলোর ছেলেমেয়েকে (আজকাল রাজনীতিতে মেয়েরাও পিছিয়ে নেই) নেতারা ডেকে নিয়ে যান। ব্যবহার করেন। ব্যবহার শেষে টিস্যু পেপারের মতো ছুড়ে ফেলে দেন। আর যদি প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে গণতন্ত্রের নামে তাকে উৎসর্গ করে দেন। ছেলেটিকে লাশ বানিয়ে ফিরিয়ে দেন তার মায়ের কোলে। তারপর আবার চরম নির্লজ্জের মতো সামনে গিয়ে দাঁড়ান। ছেলেটির জন্য মেঁকি সমবেদনা জানান। তারপর তারা আবার বের হয়ে যান আরো একটি লাশের সন্ধানে।
তিন \
দেশের শিক্ষাঙ্গণগুলোর, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা যে মোটেও সন্তোষজনক নয়, সেটা আর মাইক লাগিয়ে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। জাহাঙ্গীরনগরে ধর্ষণের সেঞ্চুরী পালিত হয়। কুষ্টিয়ায় ছাত্র কাটা হয় কঁচুকাটা স্টাইলে। রাজশাহীতে ছাত্র মেরে ফেলে দেয়া হয় ম্যানহোলে! চট্টগ্রামে চলে খুনের বদলে খুন। আর ঢাকায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কি খুব কিছু বলার দরকার আছে? প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয় আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। আর একিভূত অবস্থান ও বাহ্যিক আবরণের দিক মাথায় রাখলে মূল অক্সফোর্ড থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছুটা এগিয়ে রাখতে লাগবে। ছাত্র সংখ্যার বিচারেও আমরাই এগিয়ে। অধিভুক্ত মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ৩৭ হাজার প্রায়। আর অক্সফোর্ডের বর্তমান ছাত্র সংখ্যা ২০ হাজারের একটু বেশি।
এই কিছুদিন আগে আমার সুযোগ হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। পুরোনো শ্বেত পাথরে তৈরি বিল্ডিং। দেয়ালের কিছু কিছু স্থানে পানি জমতে জমতে কালো স্যাতসেতে দাগ পড়ে গেছে। লোহার দরজায় মরিচা পড়া, চাকচিক্য নেই তেমন তবে আভিজাত্য আছে। বেশ কয়েকটি অক্সফোর্ড ঘুরে বেড়ালাম আমি। এই সাথে একটি কথা বোধয় জানিয়ে রাখা দরকার, অক্সফোর্ড বিশেষ কোনো ইউনিভার্সিটির নাম নয় যেমনটি আমি নিজেও ভেবেছিলাম। ৪৫টি কলেজের সামষ্টিক নাম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার চোখের সামনে ছিলো মূল অক্সফোর্ড। আর আমি তখন চোখ বন্ধ করে দেখতে চেষ্টা করছিলাম আমার প্রাচ্যের অক্সফোর্ডকে। অনেকগুলো মিল আবিষ্কার করলাম আমি। এ পর্যন্ত বিশ্বে শতাধিক রাষ্ট্রপতির জন্ম দিয়েছে অক্সফোর্ড। আমার ঢাবিও মন্ত্রী এমপি কম প্রসব করেনি। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমাদের অক্সফোর্ড সব সময়ই থেকেছে সামনের কাতারে। সেই ১৯৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ এমনকি ২০০৮ এ-ও। বিগত তত্ত্বাবধায়ক আমলে অবৈধ সেই সরকারের বিরুদ্ধেও প্রথম ফুসে উঠেছিলো ঢাবির ছাত্ররাই। আমাদের অক্সফোর্ড নীতির প্রশ্নে সবসময় আন্দোলন করে থাকে, মূল অক্সফোর্ডও তাই। বর্ণবাদ ও ধর্মীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সমুন্নত রেখেছে তার সুনাম।
তবে চিন্তাটি এক জায়গায় আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো ভীষণ। অক্সফোর্ড কখনো রাজনীতির বলির পাঠা হয়নি। আর আমাদের অক্সফোর্ডটি আজ রাজনীতিবিদদের জন্য লাশ সাপ্লাইয়ের বিশ্বস্থ ঠিকানা হয়ে গেছে। আমাদের রাজনীতিক নেতাদের যখন মাঠ গরম করবার জন্য লাশের দরকার হয়, তখন তারা হাত বাড়ান ঢাবির দিকে। রক্ত তাদের বড়ই পছন্দ। বিশেষত: ছাত্রদের রক্ত। সেই ছাত্রের, যার বাবা মা একবেলা খেয়ে একবেলা উপোষ থেকে ছেলেকে পড়ার খরচ যোগান। সেই ছেলেটির, রোগে-শোকে শয্যাশায়ী মা তার ওষুদের টাকা বাঁচিয়ে ছেলের পরীক্ষার ফি যোগান। সেই ছেলেটির, যার বোনের বিয়ের জন্য জমানো টাকা আর জমানো হয় না, খরচ হয়ে যায় ভাইয়ের বই-খাতা কিনে দিতে দিতে। সেই গরীব ছেলেটির, যার দিনমজুর বাবা তার শেষ সম্বল এক চিলতে ভিটেমাটি সুদি মহাজনের কাছে বন্ধক রেখে পরিশোধ করেন ছেলের বিশ্ববিদ্যালয় সেশন ফি। আমার এ কথাগুলো মিথ্যে প্রমাণিত হলেই আমি বেশ খুশি হতাম। কিন্তু কী করবো, এটাই যে সত্য, এটাই যে বাস্তবতা। আমি জানি আমার এই কথাগুলো শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ারা বুঝবেন না। ক্ষিধের জ্বালা যে কত কষ্টের, সেটা তাদের জানা নেই। কারণ কোনোদিন তো তাদের না খেয়ে কাটাতে হয়নি।
চার \
রাজনীতির বলিরপাঠা গরীবের ছেলেগুলোরই হতে হয়। বড়লোকের সন্তান আপনি পাবেন কোথায়? শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, আমলা, তাদের ছেলে-মেয়েগুলো কি দেশে পড়ালেখা করে নাকি? ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুঁজলেও আমাদের নেতানেত্রীদের কারো সন্তানকে দেশে পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না।
আমরা, এদেশের আমজনতা, আমরা আমাদের নেতানেত্রীদের, আরো স্পেসিফিক করে বললে বিশেষ দু’টি ফ্যামিলির সাথে অদৃশ্য এক চুক্তি স্বাক্ষর করে বসে আছি। তারা হবেন শাসক, আমরা হবো শাসিত। তারা হবেন রাজা, আমরা হবো প্রজা। তারা আমাদের শাসন করবেন, শাসনের সাথে সাথে শোষনও করবেন। ইচ্ছে হলে চুষনও করবেন। করবেনই তো, আমরা তো ম্যাঙ্গ পাবলিক, আমজনতা, আমাদের চুষে খাবেন না তো কাকে খাবেন? চুক্তি মোতাবেক তারা তাদের জীবদ্দশায় হবেন শাসক, আমরা হবো শাসিত। তাদের পরে তাদের সন্তানরা হবে শাসক, আমাদের সন্তানরা হবে শাসিত। এই ধারা চলতেই থাকবে।
আমি অবাক হই, বড়বেশি অবাক হই এদেশের মুজিবসেনা-জিয়ার সৈনিকরা একটিবারও কেনো এই কথাটি ভেবে দেখে না তারা যাদের জন্য জান কুরবান করে দিতে পাগল হয়ে থাকে, অই নেতারা তাদের কী দিচ্ছেন? দেশপ্রেমে উতলা এই নেতানেত্রীরা তাদেরকে আহ্বান জানান গণতন্ত্রের গাছটির গোড়ায় রক্ত ঢালতে, দেশের স্বার্থে। মহান এই কাজটিতে তারা তাদের সন্তানগুলোকে কেন লাগাচ্ছেন না। তাদের ছেলেগুলোকে কেনো দেশে ফিরিয়ে এনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে জনগণের অধিকার (!) আদায়ের মিছিলে শরীক করাচ্ছেন না। আমি বুঝিনা এই প্রশ্নটি আমাদের ভক্তকুলের মাথায় একবারও কেনো আসে না? এত বোকা কেনো আমরা? তাহলে সত্যিই কি আমরা ম্যাঙ্গ জনতা? ‘আম’জনতা! চুষে খাওয়ার বস্তু?
পাঁচ \
আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা আজ ভাইরাস আক্রান্ত। এই ভাইরাস উড়ে আসেনি। আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। ভাইরাসটি আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে। আমরা বেড়ে উঠতে দিয়েছি। ঢালপালা ছড়িয়েছে। আমরা ছড়াতে দিয়েছি। এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, ভাইরাসটি মাথায় উঠে গেছে। অস্তিত্বের স্বার্থে মাথাটি কেটেও ফেলা যাচ্ছে না। প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার।
শিক্ষা ক্ষেত্রে এই নৈরাজ্যজনক অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এটা আমাদের দীর্ঘ অপকর্মের ফসল। নোংরা রাজনীতিই এজন্য দায়ী। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধার সূচকটি নিচের দিকে নামতে নামতে তলানি ছুই ছুই করছে। প্রীতি এবং ভীতির চমৎকার মিশেলে যে সম্পর্ক চলে আসছিলো ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে, সেখানে প্রীতি বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। ভীতিটা আছে তবে চলে এসেছে ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত অ্যাঙ্গেলে। আগে ছাত্ররা শিক্ষককে ভয় করতো। আর এখন শিক্ষকরাই ছাত্রদের ভয়ে তটস্থ থাকেন! আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথাই বলছি। আর এ জন্য শিক্ষকদেরও কিছুটা দায়ী করবো আমি। তারা যদি সাদা কালো লাল নীল বেগুনিতে বিভক্ত হয়ে যান, তাহলে তাদের কপালে এরচে’ ভাল আর কী ই বা ঝুটতে পারে। সেই সঙ্গে নীতি ও নৈতিকতার প্রসঙ্গটিও এসে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যদি ইভটিজিং এর দায়ে এক বছরের কারাদন্ড দিতে হয় কোর্টকে, তাহলে শ্রদ্ধাবোধটা আসবে কোত্থেকে?
আজকাল দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানীত শিক্ষকবৃন্দ আওয়ামী-জাতীয়তাবাদী শিবিরে বিভক্ত। আর তারা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে এত অশোভনভাবে সামনে নিয়ে আসেন যে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়ে।
ছয় \
বলছি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। কথা হলো শুধুই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই। খুব সংক্ষেপে আমার প্রাইমারী ও মাধ্যমিক লেবেল নিয়ে কিছু কথা বলেই বিদায় হচ্ছি।
মাধ্যমিক লেবেলটা হচ্ছে ছাত্রত্বের আত্মহত্যার আদর্শ সময়। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই ক্লাস সেভেন/এইট থেকে ঝরে পড়ে। টিনএজ সময়টাই এরকম। মন থাকে চঞ্চল। চোখে থাকে জীবনের রঙিন স্ফুলিঙ্গের প্রথম প্রহরের হাতছানি। এই সময়টা বড়ই খতরনাক। আলো ভেবে আগুনে ঝাপ দেয়ার আত্মঘাতি একটি প্রবণতা বিরাজ করতে থাকে আমাদের কিশোর-কিশোরীদের মাঝে। বয়ো:সন্ধির এই সময়টাতে তাদের জন্য সবচে’ বেশি যা দরকার, তাহলো প্রপার গাইড লাইন।
বিস্তারিত বলার তো সুযোগ নেই। আমি শুধু একটি কথাই বলি, আদর সোহাগ, ধমক, যেটা দরকার, সেটা ব্যবহার করেই আমার অই সকল, কিশোর-কিশোরী ভাইবোনগুলোর হাত থেকে মোবাইল ফোনটি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। মোবাইল ব্যবহারের তাদের এমন কিছু দরকার থাকতে পারে না। মোবাইল তাদের শিক্ষা জীবনের সাড়ে বাড়োটা বাজাচ্ছে। অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন যে,
অনেক কিশোর-কিশোরীরা সন্ধ্যার পর যখন পড়ার টেবিলে বসে, তখন মনে মনে কথা গুছাতে থাকে। আর অপেক্ষা করতে থাকে রাত ১২ টা বাজা’র। রাত ১১টার পর তাদের হাত মুখ কান উস-খুস করতে থাকে। ঠিক ১২ টা বাজার সাথে সাথে কয়েক লক্ষ শক্ত এবং কোমল আঙুল ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাটন টেপা-টেপিতে। শুরু হয় সারারাত কথা বলার প্রতিযোগিতা। কথা চলছে তো চলছেই। কোনো বিরাম নেই, কোনো বিরক্তি নেই। কোনো তাড়াহুড়া বা ধৈর্য্যচ্যুতি নেই। ধৈর্য্য ধরে ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে থাকার ব্যাপারটি আয়ত্বে আনবার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেটের টেষ্ট স্কোয়ার্ডকে অই রাত ১২ টার পর ওয়ালাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি ম্যানেজমেন্ট বিবেচনা করে দেখতে পারে।
কথার ধরণ-ও মাশাআল্লাহ। সুটকী তরকারীতে ঝাল বেশি হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে স্কুলের অংক আপার থুতনিতে কালো তিলের উপর গজানো একগাছি দাড়ি পর্যন্ত, কিছুই বাদ যায় না। আবার এই কথাবলার প্রতিযোগিতাও চলে খুব সাবধানে। ওয়ানডে ক্রিকেটের পাওয়ার প্লে’র মত ১৫ গজ বৃত্তের মধ্যেই থাকে তাদের আওয়াজ। কথা চালাচালিতে মাঝে মধ্যে কপট রাগ অভিমানের ফুলটস কিংবা ইয়র্কার আসে। আসে নিখুঁত লেনথের বডিলাইন বাউন্সার। কিশোর কিশোরীরা সাবধানে গা বাঁচিয়ে নেয়। আর বল একটু লোজ হলে সোজা হুক কিংবা পুল করে পাঠিয়ে দেয় সীমানার বাইরে। সোজা চার। টাইমিং ভাল হলে ছয়।
এভাবে সারারাত কথা বলে সোনামণি যখন ঘুমুতে যান, তখন পুর্বাকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। সকাল ৭ টার দিকে ঐ সন্তানের অতি সচেতন মা দরজা ধাক্কা-ধাক্কি করেন আর ডাকতে থাকেন প্রিয় কন্যাকে, (পুত্রও পড়া যাবে। সমস্যা নেই)
‘ওঠ মা, আর কত ঘুমোবি? সাতটা বেজে গেছে! তাড়াতাড়ি উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে আয়। তা না হলে আবার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে যে!’
কিন্তু সোনামণির তো ঘুম ভাঙে না। অবশ্য ভাঙার কথাও না। অই মা তো আর জানেন না, সারারাত কত পরিশ্রম করে বেচারী ঘুমুতে গেছে ভোরবেলা।
মায়ের প্রচন্ড চেঁচামেচি ও ডাকাডাকির এক পর্যায়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হয় মেয়েটিকে। আলু-তালু বেশে আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় কোনো রকম নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে চলে যাচ্ছে স্কুলে মেয়ে। গিয়ে বসছে পেছনের বেঞ্চে। কারণ ঘুমানোর জন্য পেছনের বেঞ্চ নিরাপদ। সামনের বেঞ্চগুলোতে টিচারের নজর থাকে বেশি।
স্যার যখন তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে উঠার অংক করাচ্ছেন, তখন সে গভীর ঘুমে অচেতন। আর ঘুমই তার জন্য বেশি জরুরী। আফটার অল শরীর স্বাস্থ্যও তো ঠিক রাখতে হবে। তাছাড়া গত রাতের অবশিষ্ট ঘুমকে পুষিয়ে নিতে না পারলে আসছে রাত কথা বলায়ও তো সমস্যা হবে। সেটা কোনো অবস্থাতেই হতে দেয়া যায় না। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের আতংকিত হবার কারণ রয়েছে।
সাত \
ছোট্ট ছেলে মেয়েরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, এর চে’ সুন্দর কোনো দৃশ্য সম্ভবত এই পৃথিবীতে আর নেই। হৈ-হুল্লোড়, চেঁচামেচি, লাফা-লাফির ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকা বাচ্চা-কাচ্চাদের সামনে থাকে একটি রঙিন আগামীর হাতছানি। তারা সেই আগামীর দিকে এগুতে থাকে দ্রুততার সাথে। তাদের সামনে থাকে একটুকরো সোনালী স্বপ্ন। তারা সেই স্বপ্নের জগতকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। তাদের সামনে তুলে ধরা হয় একটি সুখের সাম্রাজ্যের প্রতিচ্ছবি। ওরা সেই সাম্রাজ্যে প্রবেশ করতে চায়। ওদের বলা হয় অপেক্ষা করতে। বলা হয় লেখাপড়া করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী হও, সব সুখ, সব স্বপ্ন তোমার পায়ে এসে আছড়ে পড়বে। কঁচি মনের শিশুরা ওসব বিশ্বাস করতে থাকে। ওরা স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির সবগুলো সিঁড়ি ডিঙিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়, কিন্তু তাদের অনেকেরই মানুষ হয়ে উঠা হয় না কারণ, তাদের কেউ কোনো দিন মানুষ হতে বলেনি।
“আমাদের ভার্সিটিগুলো মন্ত্রী, এম,পি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার প্রসব করেছে, কিন্তু মানুষ প্রসব করেছে কম”-কথাটি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র। যেহেতু ভার্সিটির ছাত্ররা বড় হয়ে গেছে, তাই তাদেরকে বুঝানো কঠিন। তারচে’ বরং প্রাইমারীর ছাত্ররা এখনও নরম কাঁধানো মাটি। পোড়ানো হয়ে গেলে ইট যদি বাঁকা থেকে যায়, তখন আর সোজা করা যায় না। যা করার নরম থাকতেই করতে হবে।
শিশুরা লতানো গাছের মত। ওদের যেভাবে বেড়ে উঠতে দেয়া হবে, তারা সেভাবেই বেড়ে উঠবে। তাদের সাথে শিক্ষক এবং অভিভাবকের ব্যবহার হতে হবে কঠিন এবং কোমলের মিশ্রণে তৈরি মমতা মধুর। শিশুদের জন্য তৈরি হবে নতুন একটি ভাষা। সেটা কোনো ডিকশনারীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেটা তৈরি করে নিতে লাগবে। কোনো অবস্থাতেই শিশু মনে ক্ষত তৈরি হতে পারে-এমন কোনো আচরণ করা যাবে না। আমি অভিভাবক বা শিক্ষকমন্ডলীকে কোনো নসিহত বিলাতে বসিনি। সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী আমাকে ক্ষমা করলে আমি বিনীতভাবে অনুরোধ জানাতে চাই, লাল ডাউন, নীল ডাউন টাইপ শাস্তির নিত্য নতুন কলাকৌশল আবিস্কারের মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। পিটিয়ে হাত পা লাল করে ফেলার মাঝেও গর্ব করার কোনো কারণ নেই।
আমি জানি প্রাইমারী লেবেলের অভিজ্ঞ শিক্ষকগণ আমার কথা শুনে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দেবেন আর চোখ বড় বড় করে তাকাবেন আমার দিকে। মনে মনে বলবেন, “ব্যাটা, জ্ঞান ঝাড়ছিস! কিছুদিন প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা কর। দেখ্ দুষ্টুমী কাকে বলে? উহা কত প্রকার ও কী কী? উদাহরণ দিয়ে তোকে বুঝিয়ে দেবে ছেলে-মেয়েরা। তখন ওদের কন্ট্রল করতে হলে জ্ঞানী কথায় কাজ হবে না। ৩৬ ইঞ্চি লম্বা বেতেরই প্রয়োজন হবে।”
অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আমি বলবো জনাব, আমাদের উপমহাদেশে শিশুদের বেত পেটা করে মানুষ করা একটা ট্রেডিশনে পরিণত হয়ে গেছে। এত পেটাপেটির পরও শিক্ষার হার কিন্তু ৩৬% এর বেশি নিয়ে যাওয়া যায় নি। পাশাপাশি নজর দিন ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার দিকে। দেখুন ওসব দেশের প্রাইমারী স্কুলগুলোয় বেতের কোনো অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবেন না কিন্তু তাদের দেশে শিক্ষার হার ১০০%। এটা কীভাবে সম্ভব? কখনো ভেবে দেখেছেন?
আমি চাই সনাতনী এই পদ্ধতিটি বন্ধ করা হোক। শিশুরা যে দেশেই জন্মাক, শিশু তো শিশুই। শিশুরা দুষ্টুমী করবেনা তো কে করবে? তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মমতা দিয়ে। ওসব দেশে বিনা বেতে পড়ালেখা করাতে পারলে আমাদের দেশে নয় কেন? শত বছর তো চেষ্টা করলেন। ক্লাস রুমে ঢুকার সময় চক-ডাষ্টার এবং বেত নিয়েই ঢুকলেন। ফলাফল কতটা কী হলো? এবার এক কাজ করুন না! আগামী দশ বছরের জন্য একটি অন্যরকম পরিকল্পনা হাতে নিন। সিদ্ধান্ত নিন আগামী দশ বছর শিশুদের গায়ে হাত তোলা হবে না। আদরে আহ্লাদে মমতায় তাদের আপন করে নিয়ে পড়ানো হবে। শিক্ষক এবং প্রাইমারী ছাত্রদের মধ্যে শত বৎসর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ভীতির দেয়ালটি ভেঙ্গে ফেলা হবে। শিশুদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক হবে বন্ধুর মত।
আমি বিশ্বাস করি শাস্তি দিয়ে, গরুর মত পিটিয়েও এ পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে যে সফলতা আসেনি, আদরে-ভালবাসায় আপন করে নিয়ে মমতার অদৃশ্য জালে জড়িয়ে শিশুদের কাছে ডেকে নিলে শিশু শিক্ষায় প্রাণ ফিরে আসবে। পাশাপাশি শিশুদের কাছে খেলার মাঠেরচে’ বিদ্যালয়কে প্রিয় করে তুলতে হবে। চলুন সুন্দর আগামীর জন্য বর্তমান শিশু প্রজন্মকে একটু আদরে একটু মমতায় বড় করে তুলি। ধমকের বদলে ভালবাসার সুরে তাদের জড়িয়ে নেই। আর নিজেরাও জড়িয়ে যাই মানবতার সাথে নতুন একটি কমিটমেন্টে।
আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাটা যাদের হাতে আছে, থাকে, তাদের উপর আমাদের আস্থার সূচকটি শূন্যের ঘরে নেমে এসেছে। তাই তাদের কাছে ভাল কিছু আমরা আর আশাও করি না। তবে আমরা হতাশ হলেও পুরোপুরী নিরাশ নই। নিরাশ নই এই বাচ্চাগুলোর কারণে।
তারা বড় হবে। তারা তাদের মতো করেই বুঝতে শেখবে। আমাদের মতে তারা অতীতের কাসুন্ধি ঘাটবে না। তারা তাকাবে সামনের দিকে। শুধুই সামনের দিকে। তারপর তারা গড়ে তুলবে সেই বাংলাদেশ, ৩০ লাখ ভাই আমার যে দেশটির স্বপ্নে জীবন দিয়েছিলো। সেই দেশটি তারা গড়ে তুলবেই। সেই দিনটির জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকবো।