বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১২

টিপাই বাঁধ: সবলদের আত্মসমর্পন, দুর্বলের গর্জ্জে উঠা

এই মুহুর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচে’ বড় হুমকি কি? আওয়ামীলীগ-বিএনপির পদধারী গুটি কতেক নেতা ছাড়া দেশের সকল মানুষই একবাক্যে বলবে, টিপাই বাঁধ। টিপাই ইস্যুতে আওয়ামীলীগ গ্রহণ করেছে মিঁউ মিঁউ নীতি। বিএনপি’র অবস্থান হলো ধরি মাছ না ছুঁই পানি। ভারত আমাদের শুকিয়ে মারার প্লান করছে, আওয়ামীলীগ বলছে, মারহাবা! ভারত আমাদের ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করছে, বিএনপি বলছে, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ!!

আওয়ামীলীগ টিপাই বাঁধ’র পক্ষ নিয়েছে সরাসরি। আর বিএনপি পক্ষ নিয়েছে পরোক্ষভাবে। আর আমাদের দুর্ভাগ্য, গেলো বিশ বছর ধরে এই দু'টি দলের উপরই আমরা আস্থা রাখছি। তাদের হাতেই আমরা শপে দিচ্ছি আমাদের ভাগ্যের চাবি। তারা আমাদের অধিকারের দরজায় ঝুলিয়ে দিচ্ছেন প্রমাণ সাইজের একটি করে তালা। যে কারণে অধিকারের দাবিতে চেতনার আওয়াজগুলো আমাদের গোঙানির মতো শব্দে ঘুরপাক খেতে থাকছে চার দেয়ালের ভেতরেই। শত চেষ্টার পরেও আমরা বেরোতে পারছি না এই বেষ্টনি থেকে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর চাবি’র হাত বদল হয়, আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন আর হয় না।


এদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল মাটি যেনো এই দু’টি রাজ পরিবারের নিজেদের প্রপার্টি। এ মাটিতে ইচ্ছেমতো হালচাষ করেন তারা। আমরা ষোল কোটি মানুষ হলাম তাদের হালের বলদ। ঠিক বলদও না। বলদ হলেও কিছুটা অধিকার তো পেতাম। অন্তত দ’ুবেলা খড়কুট না হোক, ঘাস তো মিলতো। আমরা তো তাও পাই না। সব তো নিজেরাই চেটে পুটে খেয়ে ফেলেন। হায়রে চাবিওয়ালা! হায়রে চাবিওয়ালি!!


দুই


টিপাই মুখে বাঁধ হলে বাংলাদেশের অবস্থা যে কী হবে, ইতো:মধ্যেই দেশের মানুষ সেটা জেনেগেছে। নিয়মিতই লেখালেখি হচ্ছে এ নিয়ে। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। সভা-সমিতি হচ্ছে। বাংলাদেশের পাঁচ কোটি মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন যেখানে জড়িত, দেশের এক তৃতীয়াংশ ভূমি যেখানে হারিয়ে ফেলতে চলেছে তার জীবনি শক্তি, এখনই রুখে দাঁড়ানো না গেলে গোটা সিলেট ও তৎসংলগ্ন বিশাল এলাকা যেখানে পরিণত হতে চলেছে উটহীন উটের চারণ ভূমি হিশেবে, তখন আতংকিত মানুষ অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছে দেশের প্রধান দু'টি দল এই ইস্যুতে জনগণের সাথে নেই। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তারা। মানুষ নিয়ে ভাববার সময় তাদের নেই! দেশের মানুষ মরলো কি বাঁচলো, কী আসে যায়! এখন তাদের জনগণের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাওয়ার সময়। পাশে এসে দাঁড়ানোর এখনো দু বছর বাকী!!


টিপাই বাঁধ বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধীই শুধু নয়, অস্তিত্বেরও বিরোধী, এটা সুস্পষ্ট। মহাজোট সরকারের তিন বছর পুর্তি উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষনে, আমরা আশা করেছিলাম, টিপাই বাঁধ’র প্রতিবাদে সুস্পষ্ট করে কিছু বলবেন। আমরা আশা করেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে নাকি টিপাই বাঁধ’র পক্ষে তথা ভারতের পক্ষে, সেটা স্পষ্ট করবেন। আমরা হতাশ হয়েছি। বিরোধীদল গেলো ৮ জানুয়ারি তৃতীয় রোড মার্চ করলো চট্রগ্রাম অভিমুখে। প্রধান তিনটি দাবিতে। আমরা বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করলাম সেখানে টিপাই বাঁধ নেই! আর নিকট আগামীতে টিপাই অভিমুখে বিএনপির কোনো রোড মার্চ’র পরিকল্পনার কথাও জানা যায়নি! বিএনপি সম্ভবত পণ করেছে আবার ক্ষমতায় যাবার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে প্রয়োজনে ৬৪টি রোড মার্চ করবে। তবুও টিপাই অভিমুখো হবেনা তাদের গাড়িগুলো।


দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর টিপাই বাঁধ ইস্যুতে জনগণের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করাকে আমাদের জন্য জাতীয় বিপর্যয় বলা ছাড়া আর কী বলার থাকে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ নিজেদের থেকেই ছুটে আসতে শুরু করেছে রাস্তায়। দেখা যাচ্ছে টিপাই বাঁধ বিরোধী কর্মসূচি নিয়ে ছোট বড় মাঝারি- যেমন দলই মাঠে নামছে, জনগণ এসে শামিল হচ্ছে সেখানে। ভারত কর্তৃক টিপাই মুখে বাঁধ নির্মাণের পায়তারার প্রতিবাদে ইতোমধ্যে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পাটি রোড মার্চ করেছে। যদিও নিন্দুকেরা বলাবলি করছে, ডিগবাজ নেতা এরশাদ’র এই মার্চ ছিলো একটি রোটিন ওযার্ক। এটিরও ছক নাকি কষা হয়েছিলো অপার থেকে। আমরা জানি না সত্যি কি না। হলে হতে পারে।


এদেশের আলেম-উলামাদের ঐতিহ্যবাহি সংগঠন জমিয়তে ইলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশও একটি বিশাল রোড মার্চ করেছে। হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে সেই রোডমার্চটিতে। আমার জানায় গলদ না থাকলে মাত্র ৭ দিনের প্রস্তুতিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সেই মার্চটি। জমিয়তের সভাপতি আল্লামা আব্দুল মুমিন শায়খে ইমাম বাড়ি’র নেতৃত্বে সহস্রাধিক গাড়ি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটেছিলো দেশ বাঁচানোর স্লোগান দিয়ে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই টিপাই বাঁধ বিরোধী আন্দোলনে ইসলামী সংগঠনগুলোই বেশি তৎপর।

এর আগে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র আমীর চরমোনাই’র পীরের নেতৃত্বে টিপাই বাঁধ’র প্রতিবাদে একটি বিশাল রোড মার্চও হতে দেখেছি আমরা। হাসানুল হক ইনু’র জাসদ, বাসদ, খেলাফত মজলিস, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রতিবাদ করছে। লে: জে; যুবায়ের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টিপাই বাঁধ বিরোধী একটি মোর্চাও গঠিত হয়েছে। অন্যান্য সংগঠনও প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ পালন করে চলেছে বিভিন্ন কর্মসূচি। সম্প্রতি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস পালন করেছে টিপাই বিরোধী সবচে’ আলোচিত কর্মসূচি। সংগঠনের আমীর প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান’র নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সিলেট থেকে টিপাই অভিমুখি গণ-পদযাত্রার এই কর্মসুচি বিশ্ব বিবেককে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। এতোগুলো মানুষ এতখানি দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে যেয়ে কেনো এতো কষ্ট করছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নটি ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে ব্যাপকভাবে। পদযাত্রা নিয়ে আলাদাভাবে কিছু কথা বলতে চাই এ কারণে যে, এই কর্মসূচিটির সাথে ত্যাগ’র সংশ্লিষ্টতা ছিলো সবচে’ বেশি।

তিন


সিলেট থেকে পায়ে হেটে জকিগঞ্জ। আটানব্বই কিলোমিটার যাত্রা! পেশাগত কারণে সাথে থেকে না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো। এ যুগের মানুষ যেখানে একশ’ গজও পায়ে হেটে যেতে রাজি হয় না, সেখানে হাজারো মানুষ সিলেট থেকে ৩২ ঘন্টা (মধ্যেখানে নামাজ ও রাত্রী যাপনের বিরতী ছাড়া) পায়ে হেটে সীমান্ত এলাকা জকিগঞ্জ পর্যন্ত গেলো তো। দেশের প্রতি মানুষের এই যে মমতা, এই যে ত্যাগ স্বীকারের নজরানা, বিশ্বাস করতে ভরসা পাচ্ছি এই মাটির প্রতি যখনই কোনো শকুনের চোখ পড়বে, এ মাটির সন্তানেরা সেই চোখ উপড়ে ফেলার সাহস রাখে।


দীর্ঘ এই যাত্রাপথে রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের সহানুভূতি এবং দলমত নির্বিশেষ নারী-পুরুষের সমর্থন ছিলো অভূতপুর্ব। রাস্তার ধারে মহিলারা পানির জগ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থেকেছে। গায়ের খেটেখাওয়া গরীব মানুষেরা তাদের ঘামঝরানো টাকায় একটি ব্রেড, এক প্যাকেট বিস্কুট অথবা সাধ্যমত চিড়ামুড়ি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। আমি জানি এরা খেলাফত মজলিসের কর্মী না। আমি জানি এরা কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক না। এই মানূষগুলো ছুটে এসেছিলো মাটির টানে। এরা ঘর ছেড়ে বাইরে এসেছিলো বেঁচে থাকার তাগিদে। পায়ে হাটা এই কাফেলাটি জকিগঞ্জে প্রবেশকালে এলাকার হাজার হাজার মানুষ অভূতপূর্ব রিসিপশন জানায়।


টিপাই অভিমুখি যাত্রাপথে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো হাজার হাজার বাচ্চাদের মাঝে আমি বেঁচে থাকবার আকাঙ্খা দেখেছি। তাদের চেহারায় আমি শংকিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার ছাপ দেখেছি। তারা বাঁচতে চায়। এরা ডুবে মরতে চায়না। এরা শুকিয়ে মরতে চায়না। ছোট ছোট বাচ্চাদের মাঝে আমি যে চাঞ্চল্য দেখতে পেয়েছি, বলে বোঝানো মুশকিল! তারাও কীভাবে কীভাবে জানি জেনেগেছে টিপাই মুখে বাঁধ নির্মিত হলে আক্রান্ত হবে তারাই। এই বাঁধ মূল আঘাতটি যখন হানবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তখন তারাই থাকবে এদেশে। আশ্চর্য! টিপাই বাঁধ’র ভয়াবহতার কথা আমার দেশের ছোট বাচ্চারাও বুঝে ফেলেছে কিন্তু গওহর রিজভীরা বুঝতে পারছেন না! তারা বলছেন, এই বাঁধ হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না!


দেশ পরিচালনার জন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে নিতে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ফতুর করে ফেলার পরও অর্থমন্ত্রী বলছেন, টিপাই বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশের উচিৎ ফাইন্যান্স করা। ভারত আমাদের বুকে চালানোর জন্য ছুরি বানাবে, আর সেই ছুরি বানাতে আমরাই টাকা দেবো! মাথা স্ক্রু কী পরিমাণ ঢিলে হয়ে গেলে আমরা এমটি বলতে পারি, ব্রেইনের তার কয়গাছি ছিড়ে গেলে আমরা এমন ভাবনা ভাবতে পারি, কারো বুঝতে দেরি হবে না।


আমার দেশের গরিব মানুষ পেট ভরে দু'বেলা খাবার খেতে পারে না তবুও যে ভদ্রলোকদের গাড়ির জ্বালানি সাপ্লাই দেয়, তেমন এক মহা পন্ডিত, আমার দেশের পানিমন্ত্রী বলেন, ভারত দয়া করে যেটুকুন পানি দিচ্ছে, তাই তো যথেষ্ট! দালালীরও তো একটা সীমা থাকা দরকার।


চার


বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও বিএনপি টিপাই ইস্যুতে দেশের মানুষের সাথে নেই। আওয়ামীলীগ সরাসরিই টিপাই বাঁধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর বিএনপি নামকাওয়াস্তে বিরোধিতা করছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী মনমোহন সিং এর কাছে একটি পত্র লিখে এবং সিলেটে আধাবেলা হরতাল ডেকে জাতিকে উদ্ধার করে ফেলেছেন! কী লিখেছিলেন তিনি, আমরা জানি না। আর মনমোহন কী এমন মন্ত্রমিশ্রিত জবাব দিলেন যে, নেত্রী আমাদের সন্ত্রষ্ট হয়ে গেলেন, জাতি জানে না। আসলে দেশের মানুষের কথা বিবেচনায় আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র মাঝে গুণগত কোনো পাথ্যক্য নেই। নীতি তাদের অভিন্ন,


মউতা জান্নাতমে যায়ে ইয়া জাহান্নামমে, উনকো সিরিফ হালুয়াকি জরুরতহে।


আমরা সাধারণ জনগণ কখনো হরতালের সমর্থন করি না। আমরা বলছি না টিপাই ইস্যুতে দিনের পর দিন হরতাল দিয়ে দেশের অর্থনীতির সাড়ে বারোটা বাজিয়ে দেয়া হোক। তর্কের খাতিরে বলছি, এই বিএনপিকে তো আমরা খালেদা জিয়ার বাড়ির জন্যও সারা দেশে হরতাল করতে দেখলাম। যে বাড়ির সাথে একমাত্র জিয়া পরিবার ছাড়া দেশের একজন মানুষেরও স্বার্থ জড়িয়ে নেই, সেই বাড়ির জন্য সারাদেশে সারাদিন হরতাল অথচ, যে দাবির সাথে এদেশের ষোল কোটি মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক জড়িত, সেই টিপাই বাঁধ’র প্রতিবাধে শুধু সিলেটে, তাও আধাবেলা... তারপরও বিএনপি যখন দেশের মানুষের জন্য মায়া কান্না করে, যখন বলে আমরা এদেশের মাটি ও মানুষের বন্ধু, তখন দু:খ হয়। বলতে ইচ্ছে করে, ক্ষমা করো বন্ধু, মাফ চাই দোয়াও চাই। তোমার মতো বন্ধু আমাদের না থাকলেই ভালো। কু-বংশ থেকে নি:বংশ ভালো।


বিএনপি যে রাজনৈতিকভাবে কত বেশি দেউলিয়া হয়েগেছে, সেটা বোঝবার জন্যে খুব একটা ভাবাভাবি না করলেও চলে। আমি জানি না বিএনপির থিংক ট্যাংক বসে বসে মাছি মারা ছাড়া আর কী কাজটা করছে! এদশের মানুষ যেখানে অস্তিত্বের প্রশ্নে বিপর্যস্থ, দেশের সরকার যেখানে জনগণের সাথে নেই, তখনই তো বিরোধীদলের উচিৎ ছিলো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আরে বাবা, দেশের সার্থে না হোক, অন্তত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য হলেও তো বিএনপির উচিৎ ছিলো টিপাই বাঁধ’র প্রতিবাদে কাঁথাবালিশ নিয়ে মাঠে চলে আসা।


বিএনপি’র নীতি নির্ধারকদের ঘিলু নিয়ে আমাদের করুণা হয়। অতি সহজ এই ব্যপারটিও তারা বুঝতে পারলো না যে, তারা যদি টিপাই ইস্যুতে আন্দোলনের লাগামটি হাতে নিতে পারতো, তারা যদি আমজনতার কাতারে চলে এসে জনতার কাধে কাধ মিলিয়ে গর্জ্জে উঠতে পারতো ভারতীয় এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, তাহলে দেশের মানুষ, দলমত নির্বিশেষ এদেশের সকল মানুষ বিএনপির পাশে এসে দাঁড়াতো। হায়রে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা! আর ঘটনা যদি পশ্চিম দিকের কোথাও প্যাঁচ খাওয়ানো হয়ে থাকে, বিশেষ কোনো চাবিওয়ালা যদি বিএনপি’র মুখে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে থাকে, যদি বলে থাকে, ভারত আমাদের বন্ধু, আমাদের এই বন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে আমাদের নেক নজর থেকে বঞ্চিত করে ফেলবো, আর এমন কোনো কারণে যদি হয়ে থাকে বিএনপি’র এই পাশ কাটিয়ে চলা, তাহলে ছুটো মুখে একটি বড় কথা বলে রাখি। আমও যাবে, ছালাও যাবে।


পাঁচ


সিলেটের মাননীয় মেয়র! আপনার উদ্দেশ্যে বলি।

এই সিলেটের মনুষ আপনাকে তাদের সর্বোচ্চ ভালোবাসাটুকু দিয়েছে। আপনাকে সেটা সব সময় স্বীকার করতে শুনেছি। আপনাকে আমি বলতে শুনেছি প্রয়োজন হলে এই সিলেটের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে আপনি এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চান। সময় এসেছে এবার। সিলেট আজ অস্তিত্বের প্রশ্নে দিশেহারা। প্রপার অভিভাবক ছাড়াই শুরু করেছে বেঁচে থাকার লড়াই। এ লড়াইয়ে আপনাকে শুধু নিরব সমর্থন দিলেই যথেষ্ট হবে না। নেতৃত্ব দিতে হবে। আপনি আপনার দল করুন, সমস্যা নেই। কিন্তু টিপাই বাঁধ ইস্যুতে ভুলে যান দলের কথা। আপনি জানেন কেবল দলের মানুষই আপনাকে গেলো নির্বাচনে ভালোবাসা দেয়নি। গোঠা সিলেটবাসীই দিয়েছিলো। সিলেটের কান্না কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন! তাহলে কী করে পারছেন দূরে থাকতে? চলে আসুন জনতার কাতারে। তা না হলে সিলেটবাসীর আপনাকেও ক্ষমা করবে না।

প্রিয় সিলেটবাসী! আমাদের তো বাঁচতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরকে তো বাঁচাতে হবে। আমাদের সিলেটের বাঁচামরার এই আন্দোলনে আওয়ামীলীগ-বিএনপি আমাদের সাথে নেই। এর হিসাব আমরা দু’বছর পরেই নেবো। এখন আসুন, দলমতের উর্ধে উঠে রাস্তায় নামি। চলুন, আমরা তিন কোটি মানুষ বেঁচে থাকার এই সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ি। মনে রাখতে হবে কোনো জাতি যতক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যুর জন্য তৈরি হয় না, তারা বাঁচতে পারে না। চলুন, মৃত্যুর জন্য তৈরি হই। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে আমরা যদি এটুকুন করতে না পারি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

দায়হীন দায়বদ্ধতাঃসংবাদ এবং সঙবাদ

দায়হীন দায়বদ্ধতাঃসংবাদ এবং সঙবাদ


সংবাদপত্রেরচে’ ক্ষণস্থায়ী আর কোনো প্রজাতি আল্লার জমিনে আছে বলে আমার জানা নেই। বিশেষত দৈনিক সংবাদপত্র। ‘প্রজাতি’শব্দটির প্রয়োগে কারো প্রশ্ন থাকলে জানিয়ে রাখি, সংবাদপত্রকে জড়পদার্থের কাতারে গণ্য করার কোনো কারণ নেই। আমি দৃঢ়ভাবেই মনে করি, সংবাদপত্রের জীবন আছে। জীবনি শক্তি আছে। সেই শক্তি প্রয়োগের শক্তিও আছে। এবং সেটা অন্য যে কোনো কারো চেয়ে অনেক বেশি। তবুও বললাম। কেনো বললাম, সেই গল্পই ফাঁদতে বসেছি আজ।

২৪ ঘন্টারও কম এক্সপেয়ার ডেট নিয়ে জন্ম নেয় একটি খবরের কাগজ। শারীরিক গঠন প্রণালীর দিক দিয়ে সেই কাগজ আবার খুবই দুর্বল। আমরা বলি নিউজ প্রিন্ট। একই সঙ্গে আবার স্থায়িত্ব ও ক্ষমতার দিক দিয়ে বিচার করলে সংবাদপত্রের ধারেকাছেও কিছু নেই। এক্ষেত্রে নিউটন সাহেবের তৃতীয় সূত্রটি বেশ ভালভাবেই কার্যকর। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।


একটি দৈনিক সংবাদপত্রের আয়ূস্কাল কয়েকঘন্টা মাত্র। আবার শত বৎসরও। যুগের পর যুগ চলে যায়, বর্তমান হারিয়ে যায় অতীতের অরণ্যে, তবুও হারিয়ে যায় না সংবাদপত্রের কিছু অক্ষর, কিছু শব্দ। যুগ যুগ পরে আবারো ফিরে আসে নতুন করে, নতুন লেখকের হাত ধরে। দেশসেরা লেখকের কলমে শতবছর আগের সংবাদ কিংবা প্রতিবেদন উঠে আসে উদ্ধৃতির চাঁদর গায়ে জড়িয়ে। সঙ্গতকারণেই স্থায়িত্বের মানদন্ডে সংবাদপত্রের অবস্থান অনেক শক্ত ও মজবুত। স্বীকার করতেই হবে।


অত্যন্ত দুর্বল অবয়বে গঠিত একটি সংবাদপত্রের ক্ষমতা কতো?


কথাটি সহজে বুঝবার জন্য কিছু বাস্তব চিত্র সামনে নিয়ে আসা যেতে পারে। আমাদের দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিহ্নিত অপরাধীকে ধরার পর কখনো কখনো আবার ছেড়েও দেয়, লাল টেলিফোন’র চাপ থাকলে। মাঝেমধ্যে লেনদেনজনিত সন্তোষজনক পরিবেশও এক্ষেত্রে ভুমিকা রাখে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু মিডিয়া বা সংবাদপত্র কোনো অপরাধীর পিছু নিলে তাকে কবরে পোঁছার ব্যাবস্থা না করে পিছু ছাড়ে না। শায়খ রহমান ও বাংলা ভাই’র কথাতো আমরা এখনো ভুলে যাই নি! বাংলা ভাইকে ধরা হয়েছে আবার ছেড়ে দেয়াও হয়েছে। কিন্তু মিডিয়া যখন ধরেছে, প্রশাসন আর ছাড়তে পারে নি।


চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড শারমিন রিমা হত্যার ঘাতক মুনির বেঁচে যাওয়ার রাস্তা তো প্রায় বের করেই ফেলেছিলো। সম্ভব হয়নি মিডিয়ার কারণে। এরশাদ শিকদারের কথা কি মনে আছে?

‘‘আমি তো মরে যাবো চলে যাবো রেখে যাবো সবি- আছিস কি কেউ সঙ্গের সাথী সঙ্গে আমার যাবি, আমি মরেই যাবো...’’


গান বানিয়ে ছিলো সে। নিস্তার পায়নি। স্বর্ণকমল ছেড়ে তাকেও চলে যেতে হয়েছে । সঙ্গের সাথী দূরে থাক, প্রকাশ্যে পাশে দাঁড়ানোর মতোও কাউকেই পায়নি। কারণ পেছনে ছিলো মিডিয়া। আরো স্পেসিফিক করে বললে প্রিন্ট মিডিয়া বা সংবাদপত্র। তখনকার সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এতো তোড়-জোড় ছিলো না। আর এখন???



একবার তাহলে দূর থেক্র তাকানো যাক জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকা পাড়ায়। দেখে আসা যায় সেখানকার চিত্রটি কেমন?


নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপোষহীন ভালো পত্রিকা যেগুলো, (জানি না কোনগুলো, আছে নিশ্চই) সেগুলো নিয়ে কথা নেই। আমার বক্তব্য পাইকারিগুলো নিয়ে। রং মাখিয়ে ‘সঙ’ সাঝিয়ে বাজারজাতকৃত পত্রিকার কোনো অভাবই নেই দেশে। ব্যাঙ'র ছাতার সাথে তুমূল প্রতিযোগিতা করে যেভাবে নতুন নতুন পত্রিকা গজাচ্ছে, তাতে করে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ব্যুরো’র পক্ষেও সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।


যদিও সংবাদপত্রের আধিক্য আশাবাদি হবার মতেই ব্য্যাপার ছিলো, কিন্তু সততা ও বস্তুনিষ্টতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যবসাপ্রধান নীতি অবলম্বন করে সংবাদের পরিবর্তে
সঙবাদ প্রকাশে বেশি পারদর্শী অই পত্রিকাগুলো জাতির জন্য বরং খতরনাক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

ভুল তথ্য পাওয়ারচে’ তথ্য না পাওয়াইতো ভালো। ফারসি একটি কবিতাংশ হচ্ছে, কুউওয়াতে নেকি নাদারি বদ্ মকুন। এর মানে নেকি করতে না পারলে অন্তত গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা দরকার। সাংবাদিকতার নিয়ম-নীতি পায়ে দলে অসত্য বা অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশনকারী অনেকগুলো সংবাদপত্রেরচে’ সংবাদপত্র না থাকাইতো ভালো।


জন্ম ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, আমাদের সমাজে কিছু পূঁজিপতি আছেন, গরীবের ঘাম বিক্রি করে করে যারা প্রচুর টাকা-পয়সা বানিয়ে ফেলেছেন। পত্রিকা প্রকাশ করা আজকাল তাদের অন্যতম একটি শখে পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বড় কোনো ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান একটি পত্রিকা বের করলে প্রতিপক্ষ প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রত্রিকা বের করার আগ পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রেস্টিজ ইস্যু প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মেঘনা গ্রুপ (মনে করা যাক আর কি) কালান্তর নামে পত্রিকা বের করে ফেলেছ! অতএব, বুড়িগঙ্গা গ্রুপকে তো আর বসে থাকলে চলে না। আবার আসুন্ধরা গ্রুপও যে কারোচে’ কম না, সেটা প্রমাণ করারওতো একটা ব্যাপার আছে। অতএব, মোমের আলো, জমানার কণ্ঠ ...


এগুলোকে সংবাদ সেবা না বলে পত্রিকাবাণিজ্য বললে কি বাড়িয়ে বলা হবে? প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এবং নিজেকে ডিফেন্স করার কাজেই যদি পত্রিকাগুলো বেশি সচল থাকে, তাহলে কী আর বলার থাকে!


অবস্থা আজ এমন -

হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আছে, টাকাগুলো গিলে ফেলার নিয়ত করা হয়েছে, অতএব, হজম করার সুবিধার জন্য একটি পত্রিকা থাকলে সুবিধা। ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা দরকার, নিজের ঝুড়িতে একটি পত্রিকা থাকলে অনেক সুবিধা। কাজটি আসান হয়ে যায়। ঠিক যেমনটি আমরা এই কিছুদিন আগেও হতে দেখলাম। দু’য়েকটি জাতীয় পত্রিকার আচরণে। এই যদি হয় অবস্থা, সংবাদপত্রের খাসলত যদি হয় ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করা বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, অথবা এটা যদি হয় নিছক বাণিজ্য, তাহলে কী আর করা?

আমাদের সমাজে আরো কিছু ওজনদার লোক আছেন, মারাত্মক জ্ঞানী লোক। বুদ্ধির ফেরিওয়ালা। কেতাবি ভাষায় যাদের নাম বুদ্ধিজীবি। মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ি বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা অর্থে তারা বুদ্ধিজীবি হলে বাংলাদেশে তাদের বেঁচা-বিক্রি কখনো মন্দ হয় না। তাদের স্টকে সিজনাল মাল থাকে প্রচুর । যখন যেটা দরকার, মার্কেটে সেটাই ছাড়েন। সিজন পরিবর্তন হলে পণ্যও পাল্টে ফেলেন। এই বুদ্ধিটি তাদের ভালোভাবেই আছে। স্বাধে কি আর তারা বুদ্ধিজীবি!


আমরা এমন অনেক বুদ্ধিজীবির কথা জানি, বঙ্গবন্ধুর সময়ে যারা গাছেরটা খেয়েছেন গোড়ারটাও ছাড়েন নি। প্রশংসা করতে করতে বঙ্গবন্ধুকে তখন অনেকটা ফেরেশতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা তাদের মনোভাবেরও পরিবর্তন করে ফেলেছেন। তখন বঙ্গবন্ধুকে আর তাদের কাছে ফেরেশতাতো পরের কথা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য ইয়াহইয়া খানের সঙ্গে আপোষকামী একজন সাধারণ মানুষেরচে’ বেশি কিছু মনে হয় নি।


কিছু আছেন এমন, বঙ্গবন্ধুর কাছে যারা অন্যায় আবদার নিয়ে গিয়ে পাত্তা পাননি বা সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসুন্দর মন্তব্য করতেও ছাড়েন নি। আজকাল তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর নামের তসবীহ জপে জপে পেরেশান। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সকল মৃত মানুষকে সাক্ষী বানিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধু তাকে কতো বেশি ভালো বাসতেন। দেশের প্রতি তাদের ভয়াবহ দরদের কারণে স্থায়ীভাবে বিদেশে পড়ে থাকেন।


আমরা এমন অনেক বুদ্ধিজীবির কথা জানি, একসময়, সময় ভালো ছিলো যখন, সকাল-সন্ধ্যা যারা কুর্ণিশ করতেন পল্লিবন্ধুর চৌকাটে। সেই পল্লিবন্ধু, যে নেককার লোকটি প্রতি বৃহস্পতি বার দিবাগত রাতে একটি বরকতি স্বপ্ন দেখতেন। এবং পরেরদিন দলবল নিয়ে যথারীতি হাজির হতেন স্বপ্নে দেখা সেই মসজিদে। গিয়ে বলতেন, আমি গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনাদের মসজিদে জুমআর নামাজ আদায় করছি... , সেই নেতাকেও আজকাল তার সময়ে সুবিধাভোগিরা গালি-গালাজ করেন। অন্যরা একবার স্বৈরাচার বললে তারা দশবার বলতে চেষ্টা করেন।


এই ক্যাটাগরির বুদ্ধিজীবিরা যখন বুদ্ধি বিক্রির জন্য ভালো কাস্টমার পান না, তখন তারা তাদের মালদার ব্যবসায়ী বন্ধু-বান্ধবকে মটিভেট করেন একটি পত্রিকা বের করার জন্য। এতে প্রধান দু’টি লাভের মধ্যে একটি লাভ হলো, স্বাস্থ্যবান ফিগারের বেতন-ভাতা ,বাড়ি-গাড়ি এবং এক্সট্রা অডিনারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয়টি হলো, মাথার ভেতরে কিলবিল করতে থাকা সৎ/অসৎ চিন্তাগুলো সমাজে ছড়িয়ে দেয়া যায়।


বিশেষ ব্যাক্তি, গোষ্টি বা দলের পদলেহন বা তল্পিবহন যদি হয়ে যায় একটি পত্রিকার মূলনীতি, পত্রিকাটি যদি তার জন্মদাতা ও অন্নদাতাদের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে থাকে, তাহলে সেই সংবাদপত্রের আর জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না।


ব্যাবসায়ি বুদ্ধিজীবিদের খপ্পরে পড়ে কিছু কিছু সংবাদপত্র আজ নিজস্ব ঐতিহ্য হরাতে হারাতে অস্তিত্বই হারাতে বসেছে। এর প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশে কোনো মিডিয়া নীতিমালা নেই। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে কেউই জবাবদিহিতার উর্দ্ধে নয়। অন্তত থাকা উচিৎ নয়। অথচ আমাদের দেশে সংবাদপত্রগুলোকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। যার ফলে সেচ্ছাচারের দরজা-জানালা খোলাই থাকে।


ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য পত্রিকার ব্যবহার উচিৎ নয়, আমাদের দেশে তাই হয়। ব্যক্তিগত জেদ বা আক্রোশ মেটানোর জন্য পত্রিকার ব্যবহার কাম্য নয়, আমাদের দেশে তা-ও হয়। যে কারণে বস্তুনিষ্টতা নামক ব্যাপারটিকে পত্রিকার পাতায় না খুঁজে যাদুঘরে গিয়ে তালাশ করা উচিৎ কি না, কিছু কিছু মানুষ আজকাল তাই ভাবতে শুরু করেছে।

ডিজিটাল গাধা !!!

লোহাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি ভেসে থাকো কী করে? তোমার তো সবসময় ডুবে থাকবার কথা। লোহা জবাব দিলো, সঙ্গ গুণে। কলসিকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি ডুবে গেলে কী করে? তোমার তো ভেসে থাকবার কথা! কলসি জবাব দিলো এটা হয়েছে সঙ্গ দোষে।

সঙ্গ ব্যপারটি আসলে খুবই অ্যাফেক্টিভ। শয়তান ফেরেশতাদের সঙ্গ পেতে পেতে (প্রায়) ফেরেশতা হয়ে গিয়েছিলো। আবার নূহ আ.’র ছেলে সাম বিগড়ে গিয়েছিলো বখাটেদের পাল্লায় পড়ে।


নাহ, আর কোনো রাজনৈতিক হতাশার গল্প না। আজ একটি গল্প বলি।


অনেক অনেকদিন আগের কথা। ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন’ লেখা ট্রাক আবিস্কার হয়নি তখনো। ব্যবসায়ীরা মালামাল বহনে গাধা ব্যবহার করতো। সেই সময়ের গল্প। এক লোক শহরে গেছে মাল কিনতে। সেদিন আমদানি একটু বেশি ছিলো বোধ’য়। দেখলো জিনিষপত্রের দাম একটু সস্তা। সুযোগটা সে ভালোভাবেই কাজে লাগালো। অনেক মাল কিনে ফেললো সে। মালগুলো সব গাধার পিঠে তুলে দিয়ে নিজেও চেপে বসলো গাধায়। চললো বাড়ির উদ্দেশ্যে।


গাধা চলুক। অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে। এইফাঁকে আমরা বরং একটি গরুর সাথে দেখা করে আসতে পারি।


এক গৃহস্থের ছিলো এক গাই। ব্যাটা ছিলো বুদ্ধিজীবি টাইপ। তবে ভীষণ ত্যাঁদড় ছিলো সে। সব সময় পঙ্গুত্বের অভিনয় করে থাকতো। সকাল বেলা গোয়ালঘর থেকে বেরোনোর সময় পা টেনে টেনে বের হতো। মাঠে গিয়ে দিব্যি ভালো মানুষ। আবার বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় পা টেনে টেনে এসে ঢুকতো। মালিক তাকে হাল চাষের কোনো কাজেই লাগাতো না। বেচারা লেংড়া গরু...দিনকাল বেশ ভালোই কাটছিলো তার।


গাধা চলছে। মাত্রাতিরিক্ত মালের ভারে কুঁজো হয়ে চলছে বেচারা। চলতে চলতে এসে দেখা হয়ে গেলো সেই বুদ্ধিজীবি গরুর সাথে। গাধাকে এই অবস্থায় দেখে বাঁকা একটি হাসি দিয়ে সে বললো,


ব্যাটা গাধা কোথাকার! এ জন্যই তো তোর নাম গাধা। কত মাল উঠিয়েছে পীঠে! আবার নিজেও চেপে বসেছে। আর তুই টেনে নিয়ে যাচ্ছিস! গাধার গাধা।


গাধা বললো, ভাইরে, কী আর করবো বলো। গাধা হয়ে জন্মেছি। সবই কপাল!

আরে রাখ তোর কপাল। তুইও দেখছি বেকুব মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করেছিস। তারাও যখন আক্কেল দোষে কোনো বিপদে পড়ে, তখন বলে, কপালে ছিলো।

তারপর গরুটি তার লেজ নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে এক ধরণের আয়েশি ভঙ্গিতে বললো, আর এই আমাকে দেখ। আমাকে কি তোর কাছে অসুস্থ মনে হয়?

গাধা বললো, না।
কিন্তু আমার মালিকের কাছে মনে হয়। সেও তুই প্রজাতির। সে ভাবে আমি অসুস্থ। সেও মোটামুটি একটা গা...

গাধাটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগলো। বুদ্ধিজীবি বললো, আমি একদম ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই আমার। খাই ধাই, ফুর্তি করে ঘুরে বেড়াই। মালিক তো কি, মালিকের বাপেরও ক্ষমতা হয় না আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করায়।


সেটা কী করে সম্ভব! গাধার চোখে অবিশ্বাস। মুছকি একটা হাসি দিয়ে গরু বললো, এ জন্য সামান্য বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে। আর কিছু না।

কেমন বুদ্ধি ভাই? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস কররো গাথা। মুখে ব্যাঙ্গাত্বক হাসি রেখা টেনে এনে বুদ্ধিজীবি গরুটি তখন বললো,

এইতো, সকালবেলা গোয়াল ঘর থেকে বেরোনোর সময় পা টেনে টেনে বের হই। আবার বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় পা টেনে টেনে গিয়ে ঢুকি। মালিক মনে করে আমি বুঝি লেংড়া। আচ্ছা তুমি আমার ঘাড়ের দিকে চেয়ে দেখ তো! কোনো স্পট আছে?

না।
থাকার কথাও না। জীবনে কখনো কাধে জোয়াল তুললে তবে না দাগ পড়বে।
গরুর এই বুদ্ধিদ্বীপ্ত বর্ণনা শুনে গাধা তো রীতিমত অভিভূত! সে বললো, আরে ভাই! কী মচৎকার বুদ্ধি তোমার!

গরু বললো, মচৎতার মানেটা কি?

আমি আমার মালিককে মাঝেমধ্যে মচৎতার বলতে শুনেছি। এটা চমৎকারের থেকেও বেশি। বাদ দেন। গাধার সব কথা ধরতে হয় না। আচ্ছা ভাই, আপনার তো অনেক বুদ্ধি! আপনি হলেন পারফেক্ট ডিজিটাল গরু। আমাকে একটা বুদ্ধি দিন না ভাইজান। আজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আমিও আপনার মতো ডিজিটাল বুদ্ধিসম্পর্ণ ডিজিটাল গাধা হতে চাই---
(গরুর বুদ্ধি দেখে গাধা তুমি থেকে আপনিতে চলে এসেছে। এমন বুদ্ধিমান একজনকে তুমি করে বলা রীতিমত বেয়াদবি।)

গরুটি তখন মাথাটা হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, হুম। এতো করে যখন বলছো, তখন তোমার জন্য তো কিছু করতেই হয়। আচ্ছা রাখো। আমাকে একটু ভাবতে দাও। দেখি তোমার জন্য কী বরতে পারি...!


গরু আর গাধা। কথা বলছিলো হাটতে হাটতে। গাধার পীঠে বসে থাকা সলিমুদ্দিন আয়েশ করে বিড়ি ফুঁকছিলো আর ভাবছিলো, আজ মালগুলো খুব সস্তায় পাওয়া গেছে। অনেক লাভ হবে। কল্পনায় সে লাভের টাকা গুনতেও শুরু করেছে। ঠিক সেই মূহুর্তে ঘটলো একটি দুর্ঘটনা। গাধাটি হুছট খেয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। মাল গেলো একদিকে, সালিমুদ্দিন অন্যদিকে। কোমরে বেশ ভালো ব্যথা পেলো সলিমুদ্দিন। কোনো রকমে উঠে দাড়ালো সে। কিন্তু অনেক খোচাখুচির পরও গাধাকে আর উঠাতে পারলো না। কীভাবে উঠাবে? সলিমুদ্দিন তো আর জানে না এটি এক মহা বুদ্ধিজীবি গরুর সাজানো পরিকল্পনা।


গাধা যখন বুদ্ধি চাইছিলো গরুর কাছে, গরু বলেছিলো, তুমি এক কাজ করো। সামেনে ধান খেতের কোনো উচুঁ আইলে গিয়ে হুছট খেয়ে পড়ে যেও, আর উঠো না। তোমার মালিক ভাববে, পড়ে গিয়ে ব্যথা পয়েছো তুমি, তাই উঠতে পারছো না। তখন সে তার মাল অন্যভাবে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে..... সব কিছুই ঘটছে ডিজিটাল পরিকল্পনা মাফিক।


সলিমুদ্দিন পড়লেন মহা সমস্যায়। হাওরের মধ্যেখানে এতোগুলো মাল নিয়ে এখন তিনি কী করবেন? সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভালো না। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আবার রাত হয়ে গেলে ডাকাত-টাকাতের পাল্লায় পড়তে হয় কি না-কে জানে। একটু আগেই লাভ গুনছিলেন। এখন পূঁজি তো কি, জান নিয়েই টানাটানি।


ইতোমধ্যে আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। সবাই চেষ্টা করছে গাধাটিকে উঠাতে। কিন্তু গাধা তো আর উঠে না। মাটি কামড়ে পড়ে আছে সে। মুরব্বী টাইপ একলোক কাছে এসে সলিমুদ্দিনকে বললো, জনাব, আল্লাহপাকের নামে কিছু মান্নত করেন। একমাত্র আল্লাহই পারেন আপনাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।


সলিমুদ্দিন তখন বললেন, আমি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য একটি পশু সদকা করতে চাই। আপনারা আমাকে একটি ছাগলের ব্যবস্থা করে দিন।


অই যে! বুদ্ধিজীবি ছাগল, তার মালিকও ছিলো সেখানে। সে দৌড়ে কাছে এসে বললো,

জনাব, আমার একটা গরু আছে। পায়ে সামান্য সমস্যা আছে, তবে খুবই মোটাতাজা, একদম হৃষ্টপুষ্ট। আপনি এটা নিয়ে যান। মান্নত পুরা করেন। আমাকে যত খুশি দিলেই হবে। এমনিতেই এটা আমার কোনো কাম কাজে লাগে না। আপনি না হয় ছাগলের দামই দিয়েন। সমস্যা নেই।

গরু কেনা হয়ে যাবার পর লোকজন ছুরি চাকু যোগাড় করতে লাগলো। ইমাম সাহেবের অপেক্ষা করা হচ্ছে। তিনি এসে হালকা একটা মোনাজাত দিয়ে আল্লাহ’র নাম নিয়ে জবাই করবেন।


গাধা কিন্তু এতক্ষণ ধরে সব দেখছিলো। সে ভাবলো, আমাকে বুদ্ধিদাতা বুদ্ধিজীবির যদি এই হালত হয়, তাকে যদি এভাবে মেরে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়, না জানি আমার জন্য আরো কতো কঠিন পরিণাম অপেক্ষা করছে। সুতরাং আর অভিনয় করে বিপদ বাড়িয়ে লাভ নাই। এক লাফ দাড়িয়ে গেলো সে।


সলিমুদ্দিন তো মহাখুশি। যে মুরবাবী সদকা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি বলতে লাগলেন, দেখলেন তো! বলেছিলাম না আমি! আপনার সদকা হাতে হাতে কবুল হয়ে গেছে। বলেন, শূকুর আলহামদুলিল্লাহ।


সলিমুদ্দিন শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলতে বলতে গাধার পীঠে মাল উঠবাতে লাগলো। লোকজনও সাহায্য করছে তাকে। মালপত্র উঠানোর পর সে বললো, আচ্ছা ভাইয়েরা, এবার আমাকে বিদায় দিন।


লোকজন বললো, তা কী করে হয়! আপনার শিরনী আর আপনি নিজে উপস্থিত থাকবেন না, সেটা কেমন কথা?


অনেক দূর যেতে হবে আমাকে। আপনারা গোশত ভাগ করে নিয়ে যান। আমি যাই।

তাহলে কিছু গোশত নিয়ে যান সাথে করে।
ভাই, আমার গাধার পীঠে জায়গা কোথায়! এমনিতেই লোড অনেক বেশি।
লোকজন তো নাছুড় বান্দা। বললো, অন্তত মাথাটা হলেও নিয়ে যান।
কীভাবে নেব রে ভাই! উপায় নাই তো!
দাঁড়ান, একটা ব্যবস্থা করছি।
তারপর সবাই মিলে গরুর মাথা রশি দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো গাধার গলায়। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করলেন সলিমুদ্দিন।

গাধা চলছে। চলছে তো চলছেই। একে তো আগে থেকেই ছিলো অভার লোড। এখন আবার সাথে যুক্ত হয়েছে আরেকটা। বুদ্ধিজীবির মাথা। হাটতে গিয়ে মাথাটা এসে ঠাস করে বাড়ি লাগে হাটুর সাথে। ব্যথাও লাগে আবার ঢং ঢং করে শব্দও হয়। গাধাটি তখন দুঃখ করে বলতে লাগলো, আহারে!

------কু সঙ্গে সঙ্গ , গলায় ঢং ঢং !!!------

বাচ্চাদের যদি এই গল্পটি শোনানো যেতো, তাদের যদি সৎ সঙ্গ’র গুরুত্বটা গল্পের ছলে বুঝিয়ে দেয়া যেতো---

চেতনার কফিনে বিষাক্ত পেরেক!!!

৩৯ বছর পেরিয়ে গেছে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। কিন্তু এখনো যে প্রশ্নটি সচেতন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে বেড়ায়, তা হচ্ছে,
যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তেমন স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম? আর যে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম তেমন স্বাধীনতা কী আমরা পেয়েছি?

একটি পতাকা এবং স্বতন্ত্র ভূ-খণ্ডের মাঝেই যদি আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে যাই, তৃপ্তি পেয়ে যাই, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু শুধু আলাদা ভূ-খন্ড ও পতাকার নামই কি স্বাধীনতা?


স্বাধীনতা মানে তো অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা।

আমরা কি সেটা পারছি?
স্বাধীনতা মানে তো নতজানু নীতি থেকে বেরিয়ে আসা।
আমরা কী পেরেছি? তাহলে এত ভারত তোষণ কেন?
স্বাধীনতা মানে তো বুক ফুলিয়ে অধিকারের আওয়াজ দিতে পারা।
আমরা কি পারছি? তাহলে টিপাই বাধ ইস্যুতে মিঁউ মিঁউ কেনো? তিস্তার ব্যপারে কেনো জ্বি হুজুর নীতি?
স্বাধীনতা মানে তো স্বয়ং সম্পূর্ণতা।
আমরা কী হতে পেরেছি? তাহলে বারবার কেন আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য নির্লজ্জের মত হাত বাড়াচ্ছি বিদেশিদের দিকে।

বিজয় মানে তো পরাজয় এর গ্লানি গা থেকে ঝেড়ে ফেলা।

আমরা কি সেটা করতে পেরেছি? তবে কেন সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কাছে অসহায় আত্ম সমর্পন!
বিজয় মানে তো বীরত্বের গৌরব গাঁথা।
তাহলে বারবার কেন আমরা কাপুরুষের মত বিদেশিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও কটুকথা হজম করে যাচ্ছি।

কে দেবে জবাব? কার কাছে চাইবো আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর?

আওয়ামীলীগের কাছে?
বিএনপি’র কাছে?

সামরিক সরকারের শাসনামল ছাড়া বাংলাদেশের পুরোটা সময়তো পালাক্রমে এই দুটি দলই শাসন করলো। কী দিয়েছে তারা আমাদের? কী করেছে তারা আমাদের জন্য? বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তাদের কোনো অবদান আছে কী? দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানানো ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আমাদের জন্য তারা আর কী করেছেন?


তারা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করার প্লান-প্রোগ্রামে যে সময় ব্যয় করেন, সেই সময়টুকুই যদি দেশের জন্য দিতেন, নিঃসার্থ হয়ে, তাহলে বাংলাদেশকে কি অনেক উপরে উঠে যেত না? পরিবারতন্ত্রের খপ্পর থেকে আমরা কি কখনো মুক্তি পাবো না? পরিবারতন্ত্রের গ্যাড়াকল থেকে কবে বেরুবে আমাদের গণতন্ত্র? দল-নিরপেক্ষ একজন সচেতন নাগরিক তো প্রশ্ন করতেই পারে বাংলাদেশ তুমি কার?

আওয়ামীলীগের?
বিএনপি’র?
অথবা আরেকটু সাহস করে বলতে পারে বাংলাদেশ তুমি কার?
খালেদা জিয়ার?
নাকি শেখ হাসিনার?
--------------------------------

ডিসেম্বর এসেছে। প্রতি বছরই একবার করে আসে। আমাদের জানিয়ে দিতে যে, আমরা কতো বড় অকৃতজ্ঞ। আমরা সেটা গায়ে মাখিনা। লজ্জা আমাদের থেকে কতো আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে-কে জানে!


আমরা পুরুষরা লজ্জা পাইনা কারণ, লজ্জা নারীর ভূষণ! নারীরা পাইনা কারণ পুরুষের সমান অধিকারের যুগ! আর এভাবেই নির্লজ্জতা, নিমকহারামী, অকৃতজ্ঞতা ও বেঈমানিকে নিত্য সঙ্গি করেই আমাদের অদ্ভুত জীবন চলা!!


আজব এক দেশে বাস করি আমরা।

এক দেশে ছিলো এক রাজা... টাইপ দেশগুলোতেও মনে হয় এই অবস্থা নেই! এদেশে আমরা রাজাকারকেও রাষ্ট্রপতি বানাই! স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে পতাকা টানিয়ে দেই! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চাই অথচ, আস্তিনের ভেতরের সাপগুলো চোখে পড়ে না! মানবতা আর বিবেক তখন পরাজিত হয় বেয়াইআলার কাছে!

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পসরা সাজিয়ে বসি। এটি একটি সলিড পণ্য আজ। রাজনৈতিক বাণিজ্যের জন্য এরচে’ ভালো পণ্য আর হয় না। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ফিরেও তাকাই না। যদি তাকাই-ও, তারা শরীরে দেশদ্রোহিতার গন্ধ পাই। তাকে ফাসির সুসংবাদ(!) পর্যন্ত শোনাতে দ্বিধা করি না। মেজর জলিলরা, কর্ণেল তাহেররা, মুক্তিযোদ্ধারা এভাবেই যুগে যুগে আমাদের দ্বারা পুরস্কৃত হয়ে থাকেন!!!


মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য স্বয়ং বঙ্গবন্ধু যাকে বীর উত্তম খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন, সেই কাদের সিদ্দিকীকে আওয়ামীলীগের অপ শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকেও আজ রাজাকার হয়ে যেতে হয়েছে! অবাক হবো না যদি কোনোদিন ঘুম থেকে উঠে পত্রিকায় কাদের সিদ্দিকীর নামও যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় দেখি।


সরকার কথায় কথায় যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্থ করার ষঢ়তন্ত্র’র কথা বলে। কাদের সিদ্দিকীর মতো মানুষকে যারা রাজাকার বলে, বিচার বাধাগ্রস্থ করবার ষঢ়যন্ত্রকারী হিসেবে সন্দেহের তীরটা তাদের দিকে যায় না! কাচি বগলে রেখে বাইরে এতো খোঁজাখুঁজির দরকার কি! এই প্রশ্নটি কেউ করে না!

-------------------------------------------
মূল লেখাটি বছর খানেক আগেই লিখেছিলাম। আজ কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে আবার হাজির করলাম। ভাবলাম, আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই রয়ে গেছি। খাসলতের কোনো পরিবর্তন আর হয়নি। তাহলে লেখাটির উপযোগ শেষ হয়ে যায়নি।
-----------------------

আমরা ছিলাম পাকিস্তান নামক একটি দেশের খাদ্য। ২৪টি বছর তারা আমাদের ঘাড়ে চেপে রয়েছে। লেবু চিপে রস বের করার মতো বের করে নিয়েছে আমাদের শরীরের যত রক্ত। স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাসটুকু পর্যন্ত নিতে দেয়নি আমাদের! অনেকটা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটপট করছিলো তখন সাড়ে সাতকোটি বাঙালি।


এই অবস্থায় রুখে দাঁড়ানো হয়ে পড়েছিলো অনিবার্য। রুখে দাঁড়ালো সোয়া সাতকোটি মানুষ। (নিরব ও রাজাকারের আনুমানিক সংখ্যা বাদ দেয়া হলো) বিজয় ছিনিয়ে আনলাম আমরা। কিন্তু কী পেলাম? স্বাধীনতার আগে ২৪ বছর নির্যাতিত হলাম পাকিস্তান দ্বারা। আর ভারত কর্তৃক নির্যাতিত হচ্ছি চল্লিশ বছর ধরে। দিন দিন বেড়েই চলেছে নির্যাতনের মাত্রা। এ কেমন স্বাধীনতা?


২৬শে মার্চ ১৯৭১ থেকে নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮ মাস ২২ দিনে ৩০ লক্ষ জীবন এবং ২ লক্ষ সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেলাম সতন্ত্র একটি পতাকা, লাল-সবুজ। অথচ, যাদের জন্য আজ আমরা মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, তাঁরা কিন্তু ভোগছে শ্বাস কষ্টে! ফিরে তাকাবার সময় নেই আমাদের।


পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা পা হারিয়ে ঘরে বসে আছে আজ ৪০ বছর হলো। থাকুক বসে, আমাদের কী! আমরা আমাদের পায়ে সামান্য ব্যথা হলে ছুটে যাচ্ছি মাউন্ট এলিজাবেত কিংবা কিং ফাহাদে।


বোমার বিকট শব্দে শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে মানুষটি বেঁচে আছে ৪০ বছর ধরে, মরার মতো। আমাদের কী! আমরা তো আমাদের কানের চিকিৎসায় ছুটে যেতে পারছি আমেরিকায়? আমাদের হলোটা কী?


আবার ফিরে এসেছে ডিসেম্বর। কদর বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধদের। মাস জুড়ে হৈ-হল্লাড় হবে, স্মৃতি সৌদে কিছু ফুল দেয়া হবে, কিছু পদক বিতরণ হবে, কিছু আলোচনা সভা হবে, কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কিছু বিতর্ক হবে, এইতো!!


জীবিত থাকতে খোঁজ-খবর নেয়ার দরকার মনে না করলেও কিছু মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী বা এতিম ছেলে ধরে এনে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে একটি তোষা শিরণী’র প্যাকেট। যার কেতাবী নাম-মরণোত্তর পদক!


আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞস করতাম, জীবিত থাকতে আমরা তোমাদের খোঁজ নিইনি! খুব যখন বাঁচতে চাইছিলে, আমরা এগিয়ে আসিনি! আর আজ, তুমি যখন নেই, আমরা তোমাকে মরণোত্তর পদক দিচ্ছি! তুমি কি খুব খুশি হয়েছো???


আজ আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ। কিন্তু আমাদের ঘীরে আছে পরাধীনতার ডালপালা। আমাদের স্বাধীনতা আজ অরক্ষিত। আর অরক্ষিত স্বাধীনতা এবং পরাধীনতার মাঝে খুব কিছু ব্যবধান নেই।


স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমরা ভুলে বসে আছি। ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে এই দেশটি স্বাধীন করে এ জন্য দিয়ে যায়নি যে, আমরা যা ইচ্ছা তাই করবো। যেমন খুশি, তেমন চলবো। তারা তো চেয়েছিলো তাদের বাংলাদেশের মানুষগুলো মাথা উচু করে বাঁচবে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবে। সর্বোপরি নিঃশর্তভাবে দেশকে ভালবাসবে। শুধুই বাংলাদেশকে।


আমরা যদি সেটা করতে না পারি, তাহলে স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মাঝে ব্যবধান থাকলো কই?