সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১

অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা


বাংলাদেশের আকাশটা আজ ছেয়ে আছে অস্বস্থির কালো মেঘে। সমস্যা ঘরে-বাইরে । ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা দেশটিতে ৩০ লক্ষ মানুষ আজ পথে বসেছে, শেয়ার বাজার কারসাজির কারণে। জিনিষপত্রের দাম বেড়ে চলেছে হু হু করে। পদ্মা সেতু কেলেংকারির কারণে বিশ্ব ব্যাংক আমাদের গালে যে তামাচাটা মারলো, যোগাযোগমন্ত্রীকে সরিয়ে দেয়ায় সেই ক্ষত তো মিলিয়ে যাবে না।

তিস্তার পানি আনতে ব্যর্থ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন থেকে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেই তো আর সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো না।

মিস্টার কম খান খ্যাত ফারুক খানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ফেলায় চাল ডাল, আলু পটলের দাম এক কানাকড়ি কমেছে বলে জানা যায়নি।

দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় হাটা-চলার জন্য লাঠির সাহায্য নিলেও সন্তাসীরা দুর্বল হয়ে গেছে ভাবলে তো ভুল হবে।

শেয়ারবাজরে পুঁজি হারিয়ে হাহাকার করতে থাকা মানুষকে ফটকাবাজ বলা ছাড়া মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার বিরুদ্ধে আর কোনো পরিকল্পনার কথা বলতে শোনা যায় না! সব মিলিয়ে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থায় দিন কাটছে আমাদের।

সমস্যার অন্ত নেই দেশে। কোথায় সমাধান নিয়ে ভাবা হবে, তা না, কাজ ছেড়ে অকাজের দিকেই ছুটছে সরকার। গায়ের জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে আগামীর বাংলাদেশের জন্য অনেক শংকার পথ তৈরি করে রাখা হলো।

দরকার ছিলো না তবুও সংবিধান সংশোধনের নামে কমিটি, সংলাপ, মত বিনিময় নাটক ইত্যাদির পর আজ যে বস্তু সামনে এসেছে, সংবিধানের মোড়কে, এক কথায় বললে সেটাকে জগাখিচুরী না বলে উপায় নেই। সরাসরি পরস্পর বিরোধী কথামালায় সাজানো এই সংবিধানকে একটি হাস্যকর স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। কী আর বলার থাকে।

সরকারের দেউলিয়াত্বের সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ঢাকাকে দ্বিখন্ডিত করার উন্মাদীয় সিদ্দান্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকার বুকে ছুরি চালানোর এই বুদ্ধি কে দিলো, আমি জানি না। শুধু জানি, যেই দিক, তার মানসিক চিকিৎসা দরকার। চারশ বছরের ঐতিহ্যের ধারক ঢাকাকে মাত্র চার মিনিটে দুভাগ করে সরকার কোন পূণ্য হাসিল করলো, কেউ জানে না। সরকারকে এখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, বাংলাদেশের রাজধানী এখন কোথায় বলবেন? ঢাকায়? কোন ঢাকায়? উত্তর ঢাকায় না দক্ষিণ ঢাকায়? নাকি ড: আসিফ নজরুলের ভাষায় বলতে হবে, বাংলাদেশের রাজধানী এখন ঢাকাসমূহ!

শুরুতেই বলা হয়েছে বাংলাদেশের আকাশটা আজ ছেয়ে আছে অস্বস্থির কালো মেঘে। একে তো ঘরের সমস্যা। কিন্তু সব ছাড়িয়ে পড়শির ধেয়ে আসা বিষাক্ত কালো থাবা ঘুম হারাম করে দিচ্ছে আমাদের। বিশেষত আমরা সিলেটবাসীর। অস্তিত্বের প্রশ্নে আজ বিপর্যস্ত আমরা। ভরসার খুটিগুলোতেও পোঁকা ধরেছে।
আমার দেশের গরিবের রক্তের মতো ঘাম ঝরানো পয়সায় পেট ভরে খেয়ে আমাদের পানিমন্ত্রী যখন কথা বলেন, যখন লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে বলেন, ‘‘ভারত আমাদের যেটুকুন পানি দিচ্ছে, তাই তো বেশি’’, আমরা ভুলে যাই তিনি কি বাংলাদেশের মন্ত্রী নাকি ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যের!
ভারত টিপাই মুখে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরু করণের যাবতীয় পরিকল্পনা যখন গুছিয়ে এনেছে, তখনও উপদেষ্টারা যখন বলেন, যখন বলেন, ‘‘টিপাই বাঁধ ইস্যুতে ভারতের কথায় আমরা খুশি! তাদের আচরণে আমরা সন্তুষ্ট!’’ তখন আমাদের আর কোনো সন্দেহই থাকে না তাদের কমিটমেন্ট নিয়ে। আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই তারা তাদের দেশের স্বার্থেই কথা বলছেন, আমার বাংলাদেশের হয়ে নয়। আমাদের আর বুঝতে বাকী থাকেনা তারা কাদের হয়ে খেলছেন! শুধু বুঝতে পারিনা তারা তাদের প্রিয় অপারেই চলে যাচ্ছেন না কেনো?

আমার দেশের আলো-বাতাস ব্যবহার করে তারা আমাদের বুকেই ছুরি চালাবেন, তা তো হয় না।

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১১

রাজনীতিতে প্রথমকথা, শেষকথা, আসল কথা





“মাছের পচন ধরে মাথা থেকে আর জাতির পঁচন ধরে নেতা থেকে’’-কথাটি কি আর এমনি এমনি বলা হয়! অন্তত বাংলাদেশের রাজনীতিকে সামনে রাখলে!
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই কথাটি সবাই বলেন। কোনো রকমের হীনমন্যতা বা জড়তায় না ভোগেই বলে ফেলেন, যদিও নীতির মানদন্ডে এই কথাটি কতটুকু নৈতিক, সেই সহজ ব্যাপারটি বুঝবার জন্য বিদ্যাসাগর হবার দরকার হয় না।

এদেশের রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের জন্য ঐ কথাটিরচে’ নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো বস্তু আর কিছু হতে পারে বলে অন্ত-ত আমার মনে হয় না। ঐ একটিমাত্র বাক্যকে ঠিকমত বাজারজাত করতে পারার মাঝেই রাজনীতির মাঠে জগণের সাথে প্রতারণামূলক মিথ্যাচারের কাফফারা খুঁজে পেতে চান আমাদের রাজনীতিবিদরা। কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়না কারণ ঐ কথা শেষ কথা ছিল না। মুখে যা আসে তাই বলে ফেলা যায় যেহেতু শেষ কথা বলে কিছু নেই। ব্যাপারটি একটি গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রের মূল কাঠামোর অস্তিত্বের জন্য কতটা ভয়ংকর, অনুমান করে নিতে কারো সমস্যা হবার কথা না। আর এমন রাজনৈতিক বসন্তবাদীদের গলায় কেমন বিশেষন ঝুলিয়ে দেয়া যায়, বিজ্ঞজনেরাই ভাল বলতে পারবেন।


(দুই)

যদিও বলা হয় শেষ কথা নেই। আর প্রথম কথা বলে কোনো কথা আমাদের স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয় না, কিন্তু রাজনীতির আসল কথাটি আমাদের অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না কিছু। সেই আসল কথাটি হচ্ছে অনেকটা “তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’’ এর মত। কথাটির ব্যাখ্যা হতে পারে এভাবে,-


জনগণের জন্য রাজনীতি করা হবে। সেই জনগণের জন্য আন্দোলন করতে যেয়ে কখনো লাশের দরকার হলে সেই জনগণকেই লাশ বানাবেন। সেই লাশের সিঁড়িতে পা রেখে ডিঙ্গাতে থাকবেন ক্ষমতায় যাবার এক একটি সিঁড়ি। সেই পিচ্ছিল সিঁড়ি ভাঙ্গতে পা যাতে ফস্কে না যায়, সেজন্য প্রয়োজন কিছু গাম জাতীয় তরল পদার্থ। এজন্য ও ভাবার দরকার নেই। অসহায় গরীব দিন মজুরের শরীরের মূল্যহীন রক্ত তো রয়েছেই।


(তিন)


একটি উন্নয়নশীল দেশের হতভাগা নাগরিক আমরা। অনেক কিছুই আমরা আশা করি না কিন্তু সেগুলো আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়। রাজনৈতিক গলাবাজি দেখতে হয়। দল বদলের ডিগবাজি দেখতে হয়। দেখতে হয় নির্বাচন প্রাক্কলিক রাজনৈতিক চাঁদাবাজিও। আমাদেরকে অসহায়ের মত দেখতে হয় এদেশের নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরা এদেশেরই সেইসব নেতা, যারা না হলে আমরা একটি চমৎকার লাল সবুজ পতাকা পেতাম কিনা সন্দেহ, তেমন মৃত নেতাদের চৌদ্দগোষ্ঠীসহ কবর থেকে তুলে আনেন। এদেশের জন্মে যাদের অবদান, তাদেরকে টেনে হেছড়ে কবর থেকে বর করে নিয়ে আসা হয় জাতীয় সংসদে আচ্ছা করে ধোলাই দেবার জন্য।


(চার)


আমরা যারা এদেশের অত্যন্ত সাধারণ এবং দুর্বল প্রজাতির লোক, যাদের কিছু কারার ক্ষমতা নেই, সেই আমাদের নিরুপায় হয়ে মাথা নিচু করে দেখতে হয়েছে এ দেশের জাতীয় রাজনীতিবিদদের সৃষ্ট সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান বের করে দেবার জন্য ৩০ লক্ষ শহীদানের রক্তের সাথে গাদ্দারী করে স্যার নিনিয়ান স্টিফেনদের দ্বারস্থ হতে। বিউটেনিসদের দরজায় গিয়ে ধরণা দিতে। বর্তমানে অবস্থা আবার সেদিকেই যাচ্ছে কি না-ভেবে আতংকিত না হয়ে পারি না।


আধুনিক গণতন্ত্রের জননী বলা হয় যে ইংল্যান্ডকে, সেই ইংল্যান্ডে কোনো সমস্যা সমাধাণের জন্য রাস্তা-ঘাট দোকান পাঠ, অফিস আদালত বা যানবাহন বন্ধ করে দিয়ে দাবি আদায় করতে শুনা যায় না অথচ আমাদের এ দেশের, যেখানে গণতন্ত্র নামক শিশুটি এখনো নিজের পাঁয়ে দাঁড়াতে শেখেনি, সে দেশে দিনের পর দিন হরতাল ডেকে দেশের অর্থনীতির পাজড়ে লাথি মারা হচ্ছে সমানে।


কারা মারছেন?


মারছেন তারাই, যারা সকাল দুপুর সন্ধ্যায় নিয়মিত গণতন্ত্রের তছবীহ জপ করেন।


তাদের পরিচয় তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত।

তাদের পরিচয় তারা জিয়ার সৈনিক।
তাদের পরিচয় তারা আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন চায়।
তাদের পরিচয় তারা পল্লীবন্ধুর রাজনীতির দাবার গুটি।
ছোট-খাট দলগুলোকে হিসেবের বাইরেই রাখা হল কারণ এককভাবে তারা হরতাল ডেকে সফল করে ফেলবেন, তেমন ক্ষমতা তাদের নেই বলেই আমার ধারণা।

তো যারা হরতাল ডাকেন গণতান্ত্রীক অধিকারের ক্ষমতা বলে, তারা দিব্যি ভুলে বসেন হরতাল ডাকা যেমন তাদের গণতান্ত্রীক অধিকার, তেমনি সেই হরতাল মানা- না মানার অধিকারও গণতান্ত্রীক অধিকার। যদি নিজের গণতান্ত্রীক অধিকার অন্যের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাকে সৈরতন্ত্র, ফ্যসিবাদ, সেচ্ছাতন্ত্র বা যাই বলা যাক অন্তত গণতন্ত্রক বলা যায় না। আর এর নামই যদি হয় প্রকৃত গণতন্ত্র, এই জোর করে মানুষকে নিজের কথা বা নিজের দলের কথা মানতে বাধ্য করার নামই যদি হয় গণতান্ত্রীক অধিকার, তাহলে এমন গণতন্ত্র থেকে মুক্তি চাই আমরা। মুক্তি চায় এদেশের সাধারণ মানুষ।


(পাঁচ)


এদেশের মানুষ বড়ই শান্তিপ্রিয়। এতটুকু শান্তির আশায় তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে ও রাজি। এ কথা বুঝেন আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ। আর তাই এদেশের সহজ সরল মানুষের আবেগ অনুভূতিকে ব্যবহার করে থাকেন তারা বারবার ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে। নেতা-নেত্রীরা আন্দোলন ডাকেন ক্ষমতায় যাবার পথ পরিস্কার করবার জন্য। প্রয়োজনে তারা যে জনগণের জন্য রাজনীতি করেন বলে দাবি করেন, সেই জনগণকে মুখোমুখি সংঘর্ষের মাঠে ছেড়ে দিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিরাপদ কক্ষে বসে থেকে পর্যবেক্ষণ করেন তাদের জড়োকরা বা লেলিয়ে দেয়া গরীব অসহায় মানুষগুলো কে কার গা থেকে কত রক্ত ঝরাতে পারছে!


অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে আড়াই বছর পরে আমাদের নেতা-নেত্রীরা আবারো এদেশের গরীবের দরজায় এসে তাদের দুঃখ কষ্টের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবেন। কী করে এই দুঃখি চেহারাগুলো সুখের জোয়ারে ডুবিয়ে দেয়া যায়, এ নিয়ে তাদের ভয়াবহ রকম দুশ্চিন্তা দেখে যে কারো মনে হবে-ইস! এদেশের নেতা-নেত্রীদের মন কত কোমল! সাধারণ জনগণের জন্য তাদের অন্তরে কতই না দরদ!


এমন কেউ কি আছেন যিনি তখন সাহস করে দাড়িঁয়ে যাবেন ঐ সকল নেতা-নেত্রীদের মুখোমুখি। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাদের জিজ্ঞেস করবেন ---


“আগামী পাঁচটি বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আপনাদের মোট কতটি হরতাল প্রয়োজন হবে? মোট কতটি লাশ হলে চলবে আপনাদের? আপনারা যখন আপনাদের প্রয়োজনে লাশ হবার আন্দোলনে শরীক হওয়ার ডাক দিবেন আমাদের, তখন সেই রাজপথের আন্দোলনে আপনাদের সন্তাদেরকে ও পাব কি আমরা আমাদের পাশে? লাশের মিছিল কেবল অসহায় গরীব দিনমজুরদের বস্তির দিকেই এগুতে থাকবে কেনো? এভাবে আর কত কাল”? এমন কেউ কি আছেন যিনি সত্যিই দাঁড়িয়ে যাবেন এক বুক সাহস নিয়ে!


(ছয়)


আমরা এদেশের সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক স্থিতি চাই, সামাজিক প্রীতি চাই এবং তারও আগে চাই দেশের মর্যাদা। আমরা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল সমস্যার সমাধাণ চাই। তবে সেটা দেশপ্রেম আদলে, সেটা চাই দেশের ভাবমূর্ত্তির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, সেটা চাই সাধারণ মানুষের অধিকারের প্রতি যত্নশীল হয়ে।

আমরা বিশ্বাস করি আমাদের এই চাওয়া অতি স্বাভাবিক এবং ন্যায্য চাওয়া। দারিদ্র্যের অত্যাচারে জর্জরিত গরীব দেশের নাগরিক আমরা। আত্মসম্মান ছাড়া তেমন কিছুই নেই আমাদের। আমাদের এই আত্মমর্যাদা নিয়েই আমরা অহংকার করে বেঁচে থাকতে চাই। আমরা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে কি এই সামান্য অধিকারটুকু ও আশা করতে পারি না?

রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১

সরকারের বেসুরো ডুগডুগি, মনমোহনের নিরামিষ ভেলকি, মুখ্যমন্ত্রীর মোক্ষম চাল, প্রয়োজন সত্যের শাণিত উপলব্দি



অনেকগুলো প্রশ্ন ভবিষ্যতের জন্য অমীমাংসিত রেখেই বিদায় নিলেন ড. মনমোহন সিং। দু’দিন ছিলেন। আতিথেয়তায় কমতি করিনি কোনো। তিনি স্বল্পাহারি মানুষ, তবুও সাধ্যমত খাইয়েছি। বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক হিষেবে প্রাপ্য সম্মান করেছি। বিদায়বেলা দেড়শ কেজি পদ্মার ইলিশও হাদিয়া দিয়েছি। কিন্তু বহুল আলোচিত এই সফর থেকে সম্পর্কের পালে হাওয়া লাগানো ছাড়া চোখে পড়ার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা খোঁজে পাইনি আমরা। দীর্ঘ ১২ বছর পর ভারতীয় কোনো প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে নিয়ে যারা একটু বেশিই উচ্ছ্বাসিত ছিলেন, তাদেরকেও এখন মাথা নিচু করে গাইতে শুনি, স্বাদ না মিটিলো, আশা না পুরিলো......

না, আমরা নেগেটিভ সেন্স লালন করি না। এই সফর থেকে একদম কিছুই পাওয়া যায়নি বলবো না। ৪৬ টি গার্মেন্ট পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ও সীমান্ত সমাঝোতা স্মারক স্বার, এগুলোকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখতে চাই। যদিও দেশটির নাম যেহেতু ভারত, সেজন্য তাদের উপর আশা করতে ভরসা পাইনা আমরা। অতীত অভিজ্ঞতা তো আমাদের সুখকর নয়। পণ্যের গুণগত মান বা অন্য কোনো ঠুনকো অজুহাত তুলে আমাদের পণ্য যে বাতিল করে দেবে না, সীমান্তে যে বিএসএফ এর বর্বরতা বন্ধ হবেই, আর কোনো ফেলানীকে মেরে কাটাতারের সাথে ঝুলিয়ে রাখবে না, কী গ্যারান্টি আছে?

এই সফরে আরেকটি কাজ হয়েছে। আমাদের বেরুবাড়ী ভারতের হাতে তুলে দেয়ার বিনিময়ে প্রাপ্ত দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা সিটমহলে যাবার করিডোরটি ২৪ ঘন্টা খোলে দেয়ার কথা ফাইনাল হয়েছে। কীভাবে বিশ্বাস করি! এই চুক্তি তো ১৯৭৪ সালেই স্বারিত হয়েছিলো, যার সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের সংবিধান। ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে সম্পাদিত মুজিব-ইন্ধিরা চুক্তিটিকে সাংবিধানিক বৈধতা দিতেই তো আয়োজন করা হয়েছিলো তৃতীয় সংশোধনী। ২৮শে নভেম্বর ১৯৭৪ সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর শিরোনামটিই তো হচ্ছে-

“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের কতিপয় বিধানের অধিকতর সংশোধন কল্পে প্রণীত আইন।”

কেমন ছিলো চুক্তি? আমাদের সংবিধানের এই অংশটি এখনো বাংলা করা হয়নি। কেনো হয়নি কে জানে। তপশীল ১৪ অংশে চুক্তির বিবরণ দেয়া হয়েছে এভাবে-

14, Benubari- India will retain the southern half of south berubari union no 12 and the adjacent cnelaves. Measuring an area of 2.64 square mils approximately. and in exchange Bangladesh will retain the Dahagram and Angarpota cnelaves. India will lease in perctuily of Bangladesh and area of 178 metres85 metres near. `Tin bigha’ of connect Dahagram with panibari Mouza (P.S. Patgram) of Bangladesh.

বাংলায় সার সংপে বোধকরি এভাবেই দাঁড়ায়; বাংলাদেশ দক্ষিণ বেরুবাড়ির দক্ষিণ অংশের ২.৬৪ বর্গমাইল ভূমি ভারত কে দেবে। এবং ভারত আমাদের দেকে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা সিটমহল এবং সেখানে যাবার জন্য তিন বিঘা করিডোর। কিন্তু বিগত সাঁইত্রিশ বছর ধরে ভারত আমাদের নাকের ডগায় তিন বিঘার মূলো ঝুলিয়ে রেখেছে। যখন ইচ্ছ খুলে দিয়েছে, যখন ভালো লাগেনি বন্ধ করে দিয়েছে। তো বঙ্গবন্ধু যেখানে বিনিময় (বেরুবাড়ি) দিয়ে চুক্তি করেও তিনবিঘা করিডোর সুবিধা আদায় করে যেতে পারেননি, সেখানে বঙ্গবন্ধু কন্যা আবার নতুন করে সমঝোতা করে এবং বাহ্যিকভাবে বিনা বিনিময়ে এই ন্যায্য সুবিধা আমাদের পাইয়ে দেবেন, কী করে বিশ্বাস করি?

ভারত তিস্তা সই করেনি বলে বাংলাদেশও ট্রানজিট সই করেনি। এটি হচ্ছে একটি খবর। আর কে না জানে, খবরের ভেতরেই থাকে আসল খবর। আমরা যারা সাধারণ জনগণ, সেই আমরা এই আসল খবরটি নিয়েই বেশি উদ্ভিগ্ন। আমরা খুব করে চাইছি আমাদের অনুমান যেনো সঠিক না হয়। আমাদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা যেনো মিথ্যে প্রমাণিত হয়।

বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে ভারত যে রাস্তাটি চাচ্ছে, ট্রানজিটের নামে, সেটা কোনোভাবেই ট্রানজিটের সংজ্ঞায় পড়েনা। সকলেই জানি কোনো একটি দেশ থেকে দ্বিতীয় দেশের ভেতর দিয়ে গিয়ে তৃতীয় দেশে যে রাস্তা বের হয়, সেটার নাম ট্রানজিট। আর দ্বিতীয় দেশ ঘুরে আবার নিজ দেশেরই অন্য অঞ্চলে ফিরে এলে সেটা হয় করিডোর। বহুল আলোচিত ট্রানজিট নামক রোডটির রোডম্যাপ হলো দুটি।
১, কলকাতা-রায়মন্ডল-খুলনা-বরিশাল-চাদপুর-গোয়ানন্দ-সিরাজঞ্জ-বাহাদুরাবাদ-চিলমারী-ধুবড়ী
২,কলকাতা-রায়মন্ডল-বরিশাল-চাদপুর-নারায়নগঞ্জ-ভৈরব-আজমিরিগঞ্জ-মারকুলি-শেরপুর-ফেঞ্চুগঞ্জ-জকিগঞ্জ-করিমপুর
অর্থাৎ ভারত থেকেই শুরু, ভারতে গিয়েই খতম। তারপরও সরকারের বড় বড় মাথাওয়ালারা এটিকে কোন যুক্তিতে ট্রানজিট বলেন, বুঝার কোনো কুদরত নেই।

মনমোহনের এই সফরে তিস্তাচুক্তি কেনো হয়নি? ট্রানজিটের সাথে তিস্তার কী সম্পর্ক, সেটা অনুমান করবার জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু কথা সামনে আসা দরকার।
১) তিস্তার আলোচনা কিন্তু হুট করে সামনে আসেনি। গত বিশ মাস থেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে চুক্তিটির খসড়া তৈরি করা হয়েছিলো, তাহলে শেষ বিকেলে এসে গোলমাল বাঁধবে কেনো?

২) কী ছিলো চুক্তির খসড়ায়? কেউ জানে না। গোটা জাতিকে অন্ধকারে রেখেই চুক্তিটি হতে যাচ্ছিলো। মন্ত্রীসভায় আলোচনা হলো না। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে হয়ে গেলো, সেখানেও এ নিয়ে টু শব্দটি নেই। এমনকি আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়ামের সভায়ও তো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারতো। মন্ত্রী-এমপিদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলতেন জানি না। পাল্টা প্রশ্ন, জানে কে? তাও জানি না! আর এই সুযোগটি তো করে দিয়েছে আমাদের সংবিধান। আমাদের সংবিধানের ১৪১ ক ধারায় বলা আছে,
‘‘ বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।’’

এই যে, সংবিধান সংশোধন নিয়ে এতো জল ঘোলা করা হলো। কই! কাউতেই তো ১৪১ ধারাটি নিয়ে প্রশ্ন উঠাতে দেখলাম না! কেউ বললেন না, চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবার পর সেটা আর সংসদে পেশ করার দরকার কি? করলে তো আগে করা দরকার। তবেই না দেশের স্বার্থে আলাপ- আলোচনার অবকাশ থাকে। কাউকে বলতে শোনা গেলো না এখানে সম্পাদিত’র স্থলে সম্পাদনাধীন শব্দটি প্রতিস্থাপিত হোক। এই ধারার কাধে বন্দুক রেখেই তো বিদেশের সাথে দেশের স্বার্থ বিরোধী চুক্তিগুলো হয়ে যায়। জনগণকে অন্ধকারে রেখে।

সরকারি সূত্রে জানানো হলো চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া অনুযায়ী বাংলাদেশ পাচ্ছে ৪৮ শতাংশ পানি। ভারত ৫২ শতাংশ। কিন্তু মমতা বেঁকে বসার মুহুর্তে বললেন, আমাকে জানানো হয়েছিলো বাংলাদেশকে দেয়া হচ্ছে ২৫ হাজার কেউসেক কিন্তু চূড়ান্ত খসড়া হাতে আসার পর দেখতে পেলাম সেখানে লেখা ৩৩ হাজার কিউসেক। আমি ২৫ হাজারের এক ফোটা বেশি দিতেও রাজি নই।

মাথা ভনভন করতে শুরু করলে। মমতা বলছেন তিনি জানতেন ২৩ এর স্থলে ২৫। চুক্তিতে দেখতে পান ৩৩। সরকার জানালো চুক্তিতে ছিলো ৪৮%। এই ২৩, ২৫, ৩৩ ও ৪৮ এর গ্যাড়াকলে পড়ে আমাদের অবস্থা.........? কে মিথ্যাবাদী সেটা না হয় জানতে চাইলাম না। কিন্তু কে সত্যবাদী, সেটা জানার অধিকার কি আমাদের নেই?

৩) ভারতীয় মিডিয়া যেখানে আগের দিনই নিশ্চিত করেছিলো মমতার অসম্মতির কারণে তিস্তাচুক্তি হচ্ছে না। সেখানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ৬ তারিখেও বলতে শুনলাম , চুক্তি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কি জেনে গোপন করেছিলেন না জানতেনই না। যদি না জেনে থাকেন, তাহলে ঘন ঘন বিদেশ সফর করা ছাড়া আপার আর কাজটা কী? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে তাঁকে কে বলেছে? আর জেনে করলে নি:সন্দেহে জাতির সাথে মশকারা করা। কেনো করলেন জানবার অধিকার আছে আমাদের।

৪) বাঁশ থেকে যদি কঞ্চি মোটা হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ‘ডালমে কুচ কালা হায়’। বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন ড. মনমোহন সিং। তিনি গোটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গসহ। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি কাজ করতে চান কিন্তু তাঁরই দেশের একটি অঙ্গরাজ্যে তারই অধিনস্থ একজন মুখ্যমন্ত্রীর সদয় সম্মতি না থাকায় এটা করতে পারেননি, আফসোস সে কথাও আমাদের বিশ্বাস করতে বলা হয়।

৫) যেহেতু তিস্তার সাথে মমতার পশ্চিমবঙ্গ জড়িত, তাহলে আমার দেশের সরকারের মাথামোটা উপদেষ্টাদের একবারও কেনো মনে হলো না কেন্দ্র সরকারের সাথে সাথে ব্যপারটি নিয়ে রাজ্য সরকার তথা মমতার সাথেও কথা বলা দরকার। আবার ইস্যুটি যেহেতু রাজনৈতিক। তাই উপদেষ্টা নামের সাবেক এই আমলাদের দায়িত্ব দেয়ার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একবারও কেনো মনে হলো না এই কাজ আমলাদের না, এটা রাজনীতিবিদদের। ১৯৯৬ সালে ভারতের সাথে করা গঙ্গা চুক্তির কারিগরদের মধ্যে এক আব্দুস সামাদ আজাদ না হয় নেই কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সি এম শফি সামি’রা তো বেঁচে আছেন। তাদেরকে কি কাজে লাগানো যেত না?

এবার আসি মূল পয়েন্টে। তিস্তার পানি আমাদের অতি ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী ভারত আমাদের পানি দিতে বাধ্য। কিন্তু দিচ্ছে না গায়ের জোরে। আর ট্রানজিট? সেটা ঐচ্ছিক, তারা আমাদের কাছে এই সুবিধাটুকু চাইছে। ট্রানজিট দিতে বাধ্য নই আমরা। আমরা আমাদের দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে ইচ্ছে করলে দেবো না হলে নাই।

অথচ আমরা গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সাথে ল্য করছি তিস্তা ও করিডোরকে পরিকল্পিতভাবে সমান্তরাল করে ফেলা হচ্ছে! মনমোহনের এই সফরের শুরুতে অতি সুক্ষ্মভাবে বাজারজাত করা হলো, তিস্তা চুক্তি হচ্ছেই। তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিট চুক্তিও করা হবে না। সফরের মধ্যেখানে জানানো হলো, ভারত তিস্তা সই করেনি বলে বাংলাদেশও ট্রানজিট সই করেনি। সফর শেষে বিদায়বেলা মনমোহন তিস্তা চুক্তি করতে না পারায় বেজায় মন খারাপ ভাব প্রকাশ করে বললেন, অচিরেই এটি হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা জানালেন, তিন মাসের মধ্যেই তিস্তা সই হতে যাচ্ছে। কী প্রমাণ হয???

ভারত আমাদের তিস্তার পানি দেয়নি বলে আমরাও ট্রানজিট দেইনি। জনগণকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এই ম্যাসেজটি দেয়া হলো, তার মানে তিস্তা দিলে ট্রানজিটও দিয়ে দেয়া হতো। তার মানে তিস্তা সমান ট্রানজিট! আসলেই কি তাই? ট্রানজিট অতি স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার। আমরা ট্রানজিটের বিরোধী নই। বর্তমান বিশ্বের হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। তবে সেটা তো ট্রানজিটই হতে হবে। কানেকটিভিটির দরকার আছে। কিন্তু ট্রানজিটের নামে তো আর করিডোর দেয়া যায় না। বলবেন ট্রানজিট, দেবেন করিডোর, এটা কেনো?

কথা তো আরো আছে। মানলাম আমরা ভারতকে করিডোর দিতে রাজি হয়েছি। এবারে দেখবার বিষয় হলো, প্রস্তাবিত( অথবা বিএপির অভিযোগ অনুযায়ী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরেই স্বারিত) ট্রানজিটের স্বরূপ কেমন? কেমন সেটার প্রকৃতি? কেমন হবে তার প্রয়োগরীতি? সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো থেকে দায়িত্বহীন অসংলগ্ন ও পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা ছাড়া ভরসা করবার মতো কোনো তথ্য পাওয়া তো মুশকিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে প্রশ্ন করলে যে জবাব পাওয়া যাবে, তাতে মনে হবে, সামনের শনি-মংগলবারেই বুঝি সব ঝামেলা চুকে যাবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সাফ জানিয়ে দেবেন, ট্রানজিট দেবার জন্য নতুন করে আর কোনো চুক্তিরই প্রয়োজন নেই। ৭২ এর চুক্তিই যথেষ্ট। আর আমাদের মুহতারাম পানিমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তো আরেক ধাপ আগ বেড়ে বলে দেবেন, ভারত আমাদের যেটুকুন পানি দিচ্ছে, তাই তো যথেষ্ট। তাহলে সঠিক তথ্য আর পাবেন কোথায়?

বিভিন্ন সূত্র থেকে যেটুকুন জানা গেছে, ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে অবাধে চলার সুযোগ পাবে। কোনো চেকিং করা যাবে না! আমরা জানতে চাইতে পারবো না কী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! আমরা দেখতে চাইতে পারবো না ভেতরে ক’ আছে- আলু নাকি পটল? চিনি না ফেন্সিডিল? নাকি উত্তর পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী( তাদের ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবাদী) সেভেন সিস্টারকে সাইজ করবার জন্য হাতিয়ার? একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য এরচে’ বেশি খতরনাক আর কী হতে পারে?

সবকিছু মাথায় রেখে মনমোহনের এই সফরে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রযোজনায় একটি নাটক মঞ্চস্থ হলো কিনা-সেটা নিশ্চিত হতে আরো কয়েক মাস অপো করতে লাগবে। তবে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে ট্রানজিটকে হালাল করার জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবেই এই নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই তিস্তা সই করে গোপনে ট্রানজিট দিয়ে বলাহবে, আমরা কথা রেখেছি। তিস্তা আদায় করে তবেই ট্রানজিট দিয়েছি।

তিস্তার প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখেই বলছি, ট্রানজিট ও তিস্তাকে এক পাল্লায় মাপার কোনো সুযোগ নেই। আমরা পানি চাই। অবশ্যই চাই। এটা আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য। কিন্তু তার বিনিময়ে ট্রানজিট কোনো শর্ত হতে পারে না। অথচ পরিকল্পনা মাফিক সেটাই করা হচ্ছে। জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিকে এই জায়গায় এনে সেট করা হচ্ছে যে, তারা তিস্তা সই করেনি আমরা ট্রানজিট দেইনি, তারা দিলে আমরা দিতাম। এরই ধারাবাহিকতায়, আমরাদের ধারণা আগেই বলেছি, কামনা করছি মিথ্যা হোক, নামকাওয়াস্তে তিস্তা চুক্তি করে ট্রানজিট হালাল করা হয়ে যাবে জনগণকে বোঝানো হবে আমরা আমাদের দাবি আদায় করে তবেই ট্রানজিট দিয়েছি।

আমরা আমাদের সরকারকে বলি, আত্মঘাতি কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। ভারত যদি গায়ের জোরে তিস্তার পানি না দেয়, না দিক, প্রয়োজনে আমরা ১৬ কোটি মানুষ আমাদের চোখের পানি দিয়েই তিস্তার প্রবাহ সচল রাখবো তবুও আমরা চাইবো না আমাদের বুকের উপর দিয়ে ইন্ডিয়ান ট্রাক চলুক । সরকারকে আমরা বিনয়ের সাথে বলি, ট্রানজিটের ব্যপারে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে বসা ঠিক হবে না। এর সাথে দেশের ষোল কোটি মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত। এদেশের মানুষ আপনাদের ভোট দিয়েছে আপনাদের নির্বাচনি ইশতেহার দেখে। খোলে দেখুন, সেখানে কিন্তু ট্রানজিটের কথা বলা নেই। এখন ভারতকে ট্রানজিট দিতে চাইলে আবার জনগণের ম্যান্ডেট নিন। গণভোটের ব্যবস্থা করুন। দেখুস দেশের মানুষ কী চায়?

আর ঠান্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখুন দুশমন বাড়ানোর খুব বেশি দরকার আছে কি না। আজ যারা, যে ভারতীয়রা তাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে, ঊনিশ শ একাত্তর সালে এই মানুষগুলোও কিন্তু তাদের থালার ভাত শেয়ার করেছিলো আমাদের সাথে। আজ যখন তারা লড়ছে, এটাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যপার বলে আমরা না হয় চুপ করে থাকলাম যেমন আছি। কিন্তু আমাদের বাড়ি ব্যবহার করে তাদের বুকে গুলি চালানোর পথ করে দিয়ে তাদের টার্গেটে পরিণত হবো কেনো? কেনো তাদের শত্র“তে পরিণত হবো? শত্র“র কি আমাদের এতই অকাল পড়েছে যে, নতুন করে শত্র“ বানাতে হবে? আর ভারতের মতো বন্ধু খাকতে শত্র“র আর দরকারইবা কি!

বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১

সাবাস মমতা সাবাস!



নিজের ভাবমূর্তিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিলেন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায়। বাংলাদেশের সাথে প্রায় হতে চলা তিস্তা চুক্তি রুখে দিলেন তিনি। তিনি প্রমাণ করলেন, পার্শবর্তীদের সাথে সুসম্পর্ক, বন্ধুত , সেটা পরে, আগে নিজের স্বার্থ, নিজের রাজ্যের মানুষের স্বার্থ । মমতার এই মানসিকতার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। আমার দেশের ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক কুশীলবগণ কি এখান থেকে শিক্ষনীয় কিছু খোঁজে পাচ্ছেন? মনে তো হয় না!

৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড: মনমোহন সিং যখন ঢাকা সফর করছেন, তখন আমার দেশের সরকারের নীতি নির্ধারনী মহলে যারা আছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম সারির চেয়ার-টেবিলগুলো যাদের স্পর্শে ধন্য হচ্ছে, মাননীয় মন্ত্রী দীপুমনি সহ পদস্থদের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান, ‘দেখাযাক কী হয়’-টাইপ ছন্নছাড়া কথাবার্তা দেশের সাধারণ মানুষকে বরাবরের মতো বিভ্রান্তিতে ফেলে রাখে। মমতা কেনো আসেননি, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে, “ পশ্চিমবঙ্গের উপ নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত আছেন বলে আসতে পারেননি! পরে কোনো এক সময় আসবেন তিনি।

আমার দেশের সহজ সরল জনগণ ভাবলো, তাহলে কী আর করা! বেচারী নিজের বাড়িতে এতো বড় একটি আয়োজন রেখে আসবেইবা কীভাবে? আমরা আর ভাবলাম না মনমোহন’র এই সফর তো আর হুট করেই অনুষ্টিত হচ্ছে না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ভারত সফরের সময়ই এই ফিরতি সফর ঠিক হয়েছিলো। মমতা রাজ্য সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেয়ার আগে থেকেই জানতেন এই সফরের কথা। আর পশ্চিমবঙ্গের উপ নির্বাচনও নিশ্চই দু’পাঁচ দিনের নোটিশেই অনুষ্টিত হচ্ছে না। তাহলে কী করে বিশ্বাস করা যায় মমতার না আসার এটাই কারণ? সেই সাথে ভারতের পানি মন্ত্রীও নাই। ঘটনা কী?

মনমোহন সিংকে ঢাকায় রেখে শ্রদ্ধেয় মোজাম্মেল কবির’র কথার সূত্র ধরে কৌতূহলের বশেই ঢু মারলাম কোলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন এডিশনে। যদি কিছু জানা যায়। স্ববিস্ময়ে আবিস্কার করলাম আনন্দবাজার ফলাও করে বলছে,

“মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতেই শেষ মুহুর্তে আটকে গেলো বাংলাদেশের সাথে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি। ক্ষমতা গ্রহনের পর ১১০ দিনে এটাই মমতার সেরা চাল বলে মনে করা হচ্ছে। জলবণ্টন নিয়ে শতাংশের জটিল হিসেব বা সংখ্যাতত্ত্বকে পিছনে ফেলে তিনি সোজাসাপ্টা বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, রাজ্যের স্বার্থেই রুখে দাঁড়িয়ে তিনি চুক্তি আটকে দিয়েছেন। এই চুক্তি হলে আদতে বিপদ্......

তৃণমূল শিবিরের মতে, এটাই মূখ্যমন্ত্রীর মোক্ষম চাল এবং মোক্ষম সময়ে। যা দিয়ে গোটা পরিস্থিতিকে তিনি নিজের অনুক’লে এনে ফেলেছেন। রাজ্যের স্বার্থের মুখপাত্র হিসাবে ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের পাশাপাশি বাম শিবিরকে ইষৎ বিভ্রান্তও করে দিতে পেরেছেন মমতা”

বোঝতে আর বাকী রইলো না কেনো ছিলো মমতার বেঁকে বসা! আরো খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, শুকনো মওসুমে ২৩ হাজারের পরিবর্তে ২৫ হাজার কিউসেক পানি দেয়া হবে বাংলাদেশকে, মমতাকে কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে নাকি সেটাই জানানো হয়েছিলো। কিন্তু চুক্তির খসড়া হাতে পেয়ে তিনি দেখতে পান বাংলাদেশ পাচ্ছে ৩৩ হাজার কিউসেক। বেঁকে বসেন তিনি।

যদিও ইনসাফ ভিত্তিক বণ্টন হলে বাংলাদেশের ৬০ হাজার কিউসেক পানি পাবার কথা, কিন্তু যার বিজয়ে আনন্দে নৃত্য করেছিলাম আমরা আর ভাবছিলাম, পশ্চিমবঙ্গটা বুঝি আমরাই জয় করে ফেলেছি, আমাদের সেই দরদীনি মমতা পরিস্কার জানিয়ে দেন, ২৫ হাজারের একফোটা বেশি পানি দিতে তিনি রাজি নন, কখনো রাজি হবেন না। ফলে ভেস্তে যায় সবকিছু।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে আরো জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই যোগাযোগ করেছেন মমতার সাথে। ৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার চিঠি নিয়ে তাঁর একজন বিশেষ দূত মমতার সাথে দেখাও করেন। হিমালয়ের বরফ গলানো সম্ভব হয়নি তবুও। মমতা সাফ জানিয়ে দেন, এমন কোনো শর্তে তিনি চুক্তি করতে পারেন না যাতে তাঁর রাজ্যে জল সংকট তৈরি হয়।

ছয় তারিখের আনন্দবাজার’র ভাষ্য অনুযায়ী, মমতা যে আসছেন না, তিস্তা চুক্তি যে হচ্ছে না, বাংলাদেশ সেটা আগে থেকেই জানতো। পত্রিকাটি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই’র বরাত দিয়ে জানায়, “ আপাতত ঠিক হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় গিয়ে জানিয়ে আসবেন অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তি করতে ভারত বদ্ধ পরির্ক ।”

তার মানে ভারত-বাংলাদেশ, উভয়েই জানতো, এই মোলাকাতে অন্তত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। তাহলে এ নিয়ে কেনো ছিলো এতো লোকচুরি! মমতা কেনো আসছেন না-এই প্রকৃত সত্যটা জাতির সামনে প্রকাশ করতে সমস্যাটা কী ছিলো? এটা করলে তো সরকারের স্বচ্ছতাই প্রকাশ পেতো।

আমাদের প্রতি মমতার এই ভয়াবহ মমতা দেখে আমার বারবার মনে পড়তে লাগলো ছাগলের তিন বাচ্চার সেই গল্পটি। আই যে! ছাগলের দুই বাচ্চা দুধ খেয়ে লাফাচ্ছিলো আর তৃতীয়টি এমনি এমনিই তিড়িং বিড়িং করছিলো। মাস চারেক আগে মমতা যখন এক ঐতিহাসিক ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী হলেন, তখন ওখানকার দুধ খাওয়া ছাগলের বাচ্চাগুলো খুশিতে যে পরিমাণ লাফাচ্ছিলো, এখানকার আমরা, দুধ না খাওয়া অতি উৎসাহী ছাগশিশুরা লাফাচ্ছিলাম তারচে’ও কয়েকগুন বেশি! আজ যখন মূখ্যমন্ত্রী মমতা মোক্ষম সময়ে স্বরূপে আবিভূত হলেন, তিনি তাঁর দেশের প্রেক্ষাপটে রাজ্যপ্রেমের সাথে কোনো রকম আপোষে গেলেন না, তখন আমার দেশের আমরা যারা লারাচ্ছিলাম, সেই আমাদের বর্তমান চেহারাটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে আমার।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে পঞ্চাশোর্ধ অভিন্ন নদী। ভারত আছে সুবিধাজনক অবস্থানে। তারা আছে উজানে। শুকনো মওসুমে আমাদের মাটি যখন একফোটা পানির জন্য খা খা করে, তখন তারা পানি আটকে রাখে। আবার বর্ষাকালে আমরা যখন বন্যার পানিতে ভাসতে থাকি, তখন তারা বাধগুলো ছেড়ে দেয়। আমাদের কিছুই করার থাকে না! যাবার কোনো জাযগাও নেই বলে। তিন দিকে ভারত একদিকে বঙ্গপোসাগর, যাবার আর জায়গা কোথায়!!

সেই ষাটের দশক থেকে আলোচনা হতে হতে অবশেষে ৯৬ সালে এসে একটি মাত্র নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছিলো। যাকে আমরা অনেকেই ঐতিহাসিক গঙ্গাচুক্তি বলে গর্ব করতে ভালোবাসি। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি কখনো পেলাম কি না, সেটা দেখবার জন্য যে, বিশেষজ্ঞ হবার দরকার হয় না, শুকনো মওসুমে নদীটি’র মধ্যেখানে গিয়ে দাড়ালেই হয়, সেটা ভাববার তাগিদ কখনো অনুভূত হযনি!

ফিরে আসি তিস্তায়। তিস্তার উৎস সিকিমের কাংসে হিমবাহ। হিন্দু পুরান অনুসারে দেবী পার্বতীর স্তন থেকে তিস্তা’র উৎপত্তি! উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, তিন নদীর স্রোত মিলে তিস্তা। তিস্তা শব্দটি এসেছে ত্রি-সেরাতা বা তিন প্রবাহ থেকে। হিমালয়ের ৭২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে নদীটির সৃষ্টি হয়েছে। এটি দার্জিলিং এ অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে নদীটি নীলফামারী জেলার খড়িবাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের এসে প্রবেশ করতো। ১৭৮৭ সালে এসে অতিবৃষ্টিজনিত ব্যাপক বন্যার কারণে নদীটি তার গতিপথ পরিবর্তন করে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি হয়ে এসে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে চিলামারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রক্ষপুত্রে এসে মিলিত হয়।

৪২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই নদীটির ১৫১ কিলোমিটার পড়েছে সিকিমে। পশ্চিমবঙ্গে ১২৩ কি:মি:। দুই রাজ্যের সীমানা বরাবর ১৯ কি:মি;। বাংলাদেশে ১২১ কি:মি:। ভারত এখন তিস্তা থেকে বছরে পানি পাচ্ছে ১১০ কিউমেক। (ঘনমিটার/সেকেন্ড) যেখানে শুকনো মওসুমে বাংলাদেশ পাচ্ছে মাত্র ৩০ কিউমেক!। এটা কতবেশি দাদাগিরি সুলভ বণ্টন নীতি, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।

মনমোহনের এই সফরে তিস্তা চুক্তি হয়নি বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ট্রানজিট চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়নি। এতে করে কিছু মানুষকে বেশ উল্লোসিত মনে হচ্ছে। তাদেরকে আমি বলতে শুনছি, কাজের কাজ হয়েছে। আমাদের জন্য তিস্তা চুক্তি করেনি, আমরাও ট্রানজিট চুক্তি করিনি। সমুচিৎ জবাব।

তবে আমরা খুতখুতে মেজাজের সাধারণ মানুষ কিন্তু খুশি হতে পারছি না। উপরন্তু ঠিক যে কারণে কিছু ভাই আমার উল্লোসিত, সেই একই কারণেই আমরা উদ্বিগ্ন! সে অনেক দীর্ঘ কথা। আগামী কিস্তিতে বিস্তারিত আলোচনার ওয়াদা থাকলো।

সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১

কোন সে কারিগর...???



ভাবনার খোরাক হতে পারে, যদি চাই।
ছোট্ট একটি বীজ, আমের আঁটি, বড়া, নামে কী আসে যায়, তাকাই আমি,
চোখে জিজ্ঞাসা, হিসাব মিলে না কোনোভাবে!


বিস্ময়ের চাঁদর এক ঢেকে দেয় , বলে;
ভাবান্ধ! তবু, তবুও তুমি বুঝলে না। আমি ফিরে আসি বিবেকের কাছে,
যুক্তির পোষাক পরা, বলি, সমাধান কি?


লোহা শক্ত পদার্থ, শক্ত খুব, দৃঢ় চেতা,
মাটি ছাড়েনা তাকেও। মাটিকরে ফেলে , যখন বাগে পায়, আঘাত হানে,
বিবেকের কথা বলছি, বলে; কথা সত্য।


আমের আঁটিটি চলে যায় মাটির বুকে,
কী হবে? লোহার যদি হয় সাঙ্গলী্লা! তবে সেরেছে, কিছু পাবেনা খোঁজে,
যুক্তি বলে। আমি হাসি, বলি, কথাতো সত্য।


একটি বীজ/আঁটি পুঁতেছিলাম মাটিতে।
বছর ঘুরে এলো, খোঁজ নিতে যাবো ? একদিন, দেখে আসি কেমন আছে?
গন্ধও পাবে না তার, যুক্তি জবাব দেয়।


আমাকে হতবাক করে দিয়ে, যুক্তিকেও।
মিশে যাবার কথা যার মাটির সাথে, আমের সেই আটি, দাঁড়িয়ে আছে
শক্ত মাটির বুক ফেড়ে! কীভাবে কী হলো?


তাকাই যুক্তির দিকে, চোখ নামিয়ে ফেলে
হিসাব তো মিলে না, কীভাবে কী হলো? কে সেই! কোন সে মহান কারিগর?
???? ???? ????? ????? ???? ????

পুস্পকানন এবার বৃষ্টিতে ভিজবে


জীবনের আবাহন, সম্মোহন, স্বপ্নলোকের চাবি,
ঘরেফেরা, শুরু করা, জীবনের গান।
দখিনা বাতায়ন,
হিমেল হাওয়া,
ঝাকে ঝাকে হাসনাহেনার গন্ধ।
মনমাতানো,
নেশাধরানো,
অদ্ভুত অনুভূতি।

ভালোবাসার নায়ে চেপে দুই জোড়া চোখ,

চোখে চোখ রাখা,
পাল তুলে চেয়ে থাকা সুদূরে।
জোসনার আলো গায়ে মেখে এঁকে-বেঁকে
এগিয়ে যাওয়া,
পুস্পকানন এবার বৃষ্টিতে ভিজবে।

নীলাকাশ। এতো নীল।

যদি ছুঁতে পারতাম!
একমুঠো নীল যদি আমার হতো!
সাজিয়ে রাখতে পারতাম পূর্ণিমার দ্বিতীয় প্রহরে,
জোসনার মলাটে।
মেশানো যেতো জীবনের রঙে।

স্বপ্নগুলো কোনো যে নীড়ে ফেরে না।

অবেলার সাতকাহন আর কতো!
বাবুই কতো সুখি।
নীড় আছে,
স্বপ্ন আছে,
স্বপ্নকে স্পর্শ করার হাত আছে।
আমার নেই কেনো?
উড়ন্ত স্বপ্নচারি,
ভাবনার জগতকে বলো গুডবাই। কারণ,
পুস্পকানন এবার বৃষ্টিতে ভিজবে।


এ যাবৎ জীবনে, কত শত স্মৃতি কথা,

এলোমেলো, ছড়ানো, সুখ-দু:খ জড়ানো,
জমে থাকা কথামালা,
জমে থাক।
শব্দের গাঁথুনি, বাক্যের ডামাঢোল,
কথার পিঠে কথা, না বলা কথামালা,
চাপা থাক।

আজ কোনো কথা নেই।

কতোদিন, বহুদিন,
অন্যকে রাঙাতে,
দিবানিদ ভাঙাতে
এশা হয়েছে নিশা।
নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে গড়ে দিয়েছে
কত যুগলের সৌধ।
আর কতো?
জানি তুমি আসবে।

কে তুমি! অশরীরি!

হানা দিয়েছো ঘুমকাননে?
স্বপ্নের পাজর ভাঙার শব্দ কত নির্মম,
তা তো তুমি শুনতে পাওনি মেয়ে!
আঁধারের কালোকে, কী দরকার ছিলো
আলো দেয়া, ক্ষণিকের,
নাইবা যদি থাকবে!

মেয়ে কে তুমি!

এলেই যখন, নিরবে,
বারবার অনুভবের দোলায় চড়ে,
অস্তিত্বের জানান দিলে না কেনো?

কতদিন ভোরবেলা খোঁজেছে তোমায়!

স্বপ্নের আকাশে,
পাতালে।
তন্ন তন্ন করেছে গহীন অরণ্য।
বাতাসে ভালোবাসার গন্ধ,
পিছু নিয়েছে।
পায়নি কেনো?

স্বপ্নচারি!

স্বপ্নকন্যা তোমার, ভুল ভেঙেছে,
বুল ফুটেছে।
বাড়িয়েছে হাত।
চলো, হাতে হাত রাখো।
গড়ে তুলো স্বপ্নের প্রাসাদ।
আজাদীর যবনিকা, মন যদি ভেঙে যায়,
খুশি হও এই ভেবে,
পুস্পকানন এবার বৃষ্টিতে ভিজবেই।


স্বপ্নচারির হাতধরে স্বপ্নবোনার স্বপ্ন,

স্বপ্নখরার বেসাতি, বৃষ্টি নেই!
বেদনার নীল ফেড়ে মুখ তুলে তাকানো,
রঙধনুর সাত-সপ্তমি,
খোঁজে ফেরা ভালোবাসার রঙ।
কী যেনো?

একজীবনের ধুলোমাখা স্বপ্ন,

ছাইপাশের স্তুপ,
স্বপ্নেরা উঁকি দিতে চায়।
প্রতীক্ষার প্রহর গোনা, একপশলা বৃষ্টির।

কথাগুলো, আশাগুলো,

তিলে তিলে লালিত স্বপ্নের ভাষাগুলো,
বুকে ছিলো। মুখ ছিলো, ছিলো না।
আহারে!

একজন কেউ যদি একবার,

শুধুমাত্র একবার, বলতো,
চলো ধরো হাত...

স্বপ্নচারিনি,

চোখ বুঝি ভিজেছে! মুছে নাও।
আবেগের বেগদ্বার খোলে দাও।
চোখ খোলো, মুখ তোলো আকাশে-
পুস্পকানন এবার বৃষ্টিতে ভিজবেই।


নিভৃত স্বপ্নচারি,

একজন আবুল কালাম।
আজাদ ছিলো।
অন্তহীন আজাদী, মানে নেই।
লাগামহীন জীবনে, হতে নেই, হতে দিতে নেই।
সানাইয়ের সুর, বহুদিন, দূরে ঠেলে দিতে নেই।

একজন স্বপ্নচারিনি,

সালমা বোধ’য়।
নামের বাঁকে বাঁকে শান্তির কণাগুলো,
আশাগুলো, ভালোবাসাগুলো
বেঁচে থাক, সাথে থাক।
গড়ে উঠুক নন্দনকানন সেই।

বাগানবাড়ির বাতায়নগুলো

জড়িয়ে যাবে লতানো ডালে,
যাক না।
বেলি-চাঁপার কলকাকলিতে জেগে উঠবে অন্য কোনো কুসুমকলি।
উঠুক না।

জানি পরে কী হবে!

ঐ যে!
সেই কলি ফুল হবে।
জানান দেবে পাপড়ি মেলার।
পুস্পকানন এবার...

কলি হোক, ফুল হোক,

ফুলে ফুলে ভরে উঠুক বাগানটি।
প্রতিদিন ভোর হোক,
ঘুম থেকে জাগা হোক ফুলেদের চিৎকারে!
পড়শীর মুখে মুখে চলুক কথা-
কোন কাননের ফুল যেনো...?

ধৈর্য ও প্রতীক্ষার রজনী,

এ তো শুধু একদিক।
উল্টো পিঠেই তার প্রাপ্তি ও আনন্দ,
অপরূপ দিন-রাত।
দিবসের এই দ্বি-প্রহরে জীবনের জয় হোক।
ক্ষয় হোক অপ্রাপ্তির।
কষ্ট জরা হতাশা, ঘুছে যাক, মুছে যাক। পুস্পকাননে অমীয় ঝরণাধারা,
জীবনের জয় হোক।

জীবনের দুপুরে

এসে,
হেসে,
ভালোবেসে,
বলার আছে কিছু?

দরকার নেই।

আজ কোনো কথা নয়।
কোনো কথা শোনা নয়।
আজ শুধু বৃষ্টি ভেজার দিন।

চোখে চোখ রাখা- জয় হোক।

হাতে হাত রাখা- জয় হোক।
বুকে মাথা রাখা- জয় হোক।


জীবনের জয় হোক।

শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১১

গণতন্ত্র , গোড়ায় গলদ কি না?

ব্যাপারটি নিয়ে ভাবছি বেশ কিছুদিন হলো। সমাধান খুঁজে পাচ্ছিনা। কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছিনা। পাছে না আবার ভাবে, পাগল! আদার খুচরো দোকানদার, জাহাজ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে! পরে ভাবলাম যা আছে কপালে। জাতির সাথেই শেয়ার করি। দু’পাঁচ জনের কাছে পাগল সেজে লাভ নেই। পাগল বললে পুরো জাতি পাগল বলুক। জাতীয় পাগল হতে পারাও মন্দ হবে না।

বর্তমান বিশ্বে সবচে’ সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের দেশেও। যদিও এদেশে গণতন্ত্রের পোশাক পরে রাজতন্ত্রের অশরীরি আত্মাগুলোকেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, তবুও। 

যদিও আমাদের গণতন্ত্রের থলের ভেতরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকতে দেখা যায় উর্দি শাসনকে স্বাগত জানানোর পাইক-পেয়াদাদের, তুবও। 

আমরা ভাবতে ভালোবাসি, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। যদিও এদেশের রাস্তা-ঘাটে, গ্রাম-শহরে, অফিস-আদালতে, এমনকি জাতীয় সংসদেও, অবলা গণতন্ত্রকে ধর্ষিত হতে দেখা যায়। গণতন্ত্রের কোমল বুকে ছুরি বসিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে মসনদ হাসিল করার ঘটনাও ঘটে। তবুও। 

আমরা সেই গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করি। যে গণতন্ত্রের বুকে পা রেখে উপরে উঠা যায়। সেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি আমরা, যে গণতন্ত্র আমাদের পৌঁছে দিতে পারে ক্ষমতার শীর্ষ বিন্দুতে। আমরা গণতন্ত্রের প্রতি ততক্ষণ আস্থাশীল থাকতে পারি, যতক্ষণ আমার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে বাধা হয়ে দাড়ায় না।

গণতন্ত্র মানে হচ্ছে, জনগণের জন্য জনগণের মনোনিত জনগণের সরকার। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জনগণ যাকে চাইবে, যাদেরকে চাইবে, তারাই করবে সরকার গঠন। তারাই চালাবে রাষ্ট্র। কিন্তু কথা হচ্ছে দেশের সকল মানুষের চাওয়া তো আর সমান হয়না। কেউ চায় অমুককে তো কেউ চায় তমুককে। কেউ ভোট দেয় আম গাছকে তো কেউ আবার তাল গাছকে। এ জন্য ব্যাপারটির নিষ্পত্তি করা হয়েছে এভাবে,

কোনো আসনের অধিকাংশ মানুষ যাকে ভোট দেবে, তিনিই হবেন নির্বাচিত। আরবীতেও একটা মূলনীতি আছে, আল আকসারু হুকমুল কুল। অধিকাংশের মতামতকে সকলের মতামত হিসেবে গণ্য করে নেয়া যেতে পারে। অনেকটা এভাবেই।

এ ধারাই অনুসৃত হয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী। স্থানীয় নির্বাচন থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত। কোনো নির্বাচনী এলাকায় অধিকাংশ মানুষ যাকে সমর্থন জানাচ্ছে, তিনিই পাচ্ছেন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের খেদমত (!) করবার সুযোগ। আর আমার প্রশ্ন এখানেই। আমার খটকার জায়গাটিই এটি। আমার বোঝার ভুলও হতে পারে। কেউ হয়তো ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করবেন। সমস্যাটির ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। সমাধান নিয়ে ভাবা হয়নি। কেউ হয়তো ভাববেন। কিংবা কে জানে অন্য কোনো সূত্রে বিষয়টি মীমাংসিতই আছে কিনা। জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো আমি। আর এই সাথে জানিয়ে রাখি, গণতন্ত্রের ফজিলত বর্ণনা করা বা পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করার জন্য এই লেখা নয়। বিষয়টি হচ্ছে গণতন্ত্রের কেতাবী সংজ্ঞা এবং প্রায়োগিক বাস্তবতার মাঝে মিল-অমিল সংক্রান্ত।

বুঝতে পারছিনা কীভাবে প্রকাশ করবো। গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর মূল কথা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের পছন্দ ও সমর্থনের ভিত্তিতেই জন-প্রতিনিধি বা সরকার গঠিত হবে। কিন্তু একটু সুক্ষ্মভাবে কালকুলেশনে গেলে দেখা যায় এর ব্যতিক্রম হয়েও সরকার গঠিত হতে পারে। আর হচ্ছেও। তাও আবার গণতান্ত্রিকভাবেই। দেখা গেলো, অধিকাংশ মানুষ কাউকে বা কোনো দলকে পছন্দ করলো না, সমর্থন জানালো না, তারা চাইলোনা এরা নির্বাচিত হোক বা সরকার গঠন করুক। কিন্তু গণতন্ত্রের দেয়ালের ঠিক মধ্যেখানে থাকা বেশ বড় একটি ছিদ্র দিয়ে তাদেরও সুযোগ হয়ে উঠছে নির্বাচিত হবার বা সরকার গঠনের। আর এমনটি অহরহই হচ্ছে। উদাহরণ দিচ্ছি।

মনে করা যাক, কোনো আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ। নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ৫ জন। ভোট কাস্ট হলো ৮০%। ধরে নেয়া যাক হিসাবটা দাঁড়ালো এভাবে, যিনি নির্বাচিত হলেন, তিনি পেলেন ৯০ হাজার ভোট। ২য় অবস্থানে থাকা প্রার্থী পেলেন ৮০ হাজার। ৩য় জন ৪০ হাজার। বাকী দু’জন পেলেন ৩০ হাজার ভোট। এলাকার ২০% বা ৬০ হাজার লোক ভোট দেয়নি অর্থাৎ কাউকেই সমর্থন জানায়নি।

এবারে অবস্থা দাঁড়ালো এই যে, মিস্টার এক্স ৯০ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে গেলেন। এর মানে তার এলাকার ৯০ হাজার মানুষ সমর্থন জানালো তাকে। তারা চাইলো মিস্টার এক্স এমপি হোন। কিন্তু পরাজিত ৪ প্রার্থী মিলে পেয়েছিলেন ৮০ হাজার যোগ ৪০ হাজার যোগ ৩০ হাজার সমান ১ লক্ষ ৫০ হাজার ভোট। এর মানে এই দেড় লক্ষ মানুষ মিস্টার এক্সকে চাইল না। তারা চেয়েছে তার বিকল্প। আর তাদের এই চাওয়াটা খন্ড খন্ড হয়ে যাওয়াতে সুযোগটা পেয়ে যান মিস্টার এক্স। ফলাফল দাঁড়ালো, ৯০ হাজার মানুষের পছন্দ এবং দেড় লক্ষ মানুষের অপছন্দকে পুঁজি করে গণতন্ত্রের ছিদ্র দিয়ে তিনিই হয়ে গেলেন নির্বাচিত! গণতন্ত্রের মূল কথাটি আবারো সামনে নিয়ে আসা যাক। জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন অধিকাংশের সমর্থনের ভিত্তিতে। অথচ এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। অধিকাংশ মানুষ যাকে চায়নি, তিনিই হয়ে যাচ্ছেন নির্বাচিত। ব্যাপারটি কেমন হয়ে গেলো না?

পূর্বোল্লিখিত সম্ভাবনা এবং অনেকটা বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে যে ছকটি দাঁড়ায়, তা হচ্ছে, দেখা গেলো কোনো দল প্রদত্ত ভোটের ৪৫% ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার গঠন করে ফেললো। সেটা হলো একটা গণতান্ত্রিক সরকার।

অথচ সরকারকে ভোট দেয়নি- এমন মানুষের সংখ্যা ৫৫%। তাহলে কেমন করে বলা যায় গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় দেশের অধিকাংশ মানুষের মতামতের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হয়ে থাকে? ব্যাপারটির কোনো সহজ সমাধান আপাতত সামনে নেই আমার। চিন্তাজীবি যারা, তাদের কাছে থাকলেও থাকতে পারে।

অতি সম্প্রতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে একটি ফর্মুলা প্রস্তাব করেছেন। বলেছেন, নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। অর্থাৎ, মানুষ বিশেষ কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবেনা। ভোট দেবে নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল ইত্যাদি মার্কাকে অর্থাৎ দলকে। যে দল সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পাবে, তারাই করবে সরকার গঠন। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে স্ব স্ব দল প্রার্থী মনোনিত করে তাদের জীবনের আমলনামাসহ নির্বাচন কমিশনে পাঠাবে। নির্বাচন কমিশন মনোনিত ব্যক্তিকে সার্বিক বিবেচনায় যোগ্য মনে করলে তবেই তাকে ঘোষণা করা হবে নির্বাচিত হিসেবে।

এরশাদ সাহেবের এই ফর্মূলার পক্ষে বিপক্ষে দুদিকেই যুক্তি আছে। ফর্মূলাটি গ্রহণ করে নেয়া হলে কালোটাকার মালিকরা টাকার বিনিময়ে ভোট কিনে এমপি হবার সুযোগ পাবেন না। পেশি শক্তির কিংবদন্তিরা জোর করে কেন্দ্রদখল করে এবং গায়ের জোরে জিতে আসার সুযোগ পাবেন না। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ মানুষ যাদের চাইবে তারাই করবে সরকার গঠন। কারণ সামনে থাকবে প্রাপ্ত ভোটের সর্বমোটের আনুপাতিক পরিসংখ্যান। আবার এর দুর্বল দিকও আছে। এতে কার দলের প্রধান ও প্রভাবশালী অংশের সেচ্ছাচারিতা ও দৌরাত্ব লাগামহীন হয়ে যেতে পারে। তাদের ভাই-বেরাদার, ভাগ্নে-মামা তথা আত্মীয়-স্বজনদের ভারে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে সংসদ। যেহেতু মাঠ পর্যায়ে পয়সা খরচ করতে হচ্ছেনা, সে জন্যে কোঠি টাকার নমিনেশন বাণিজ্যের স্থলে মনোনয়ন বাণিজ্যের টাকার অংক চলে যেতে পারে শত কোটিতে। সেই সঙ্গে সংসদ ভরে যেতে পারে অযোগ্যদের দ্বারা।

গণতন্ত্রের যে দুর্বল দিকটির কথা আমি উল্লেখ করলাম, জানি না সেটা আসলেই দুর্বলতা কিনা! হয়ে থাকলে এর সমাধান কী?

মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০১১

পান্তা ইলিশ, বাঙালি


 আরো একটি পহেলা বোশেখকে স্বাগত জানাবো বলে আমরা প্রস্তুত। প্রতি বছরই একবার করে  এ প্রস্তুতি আমরা নিই। বাংলা সন তারিখের জন্মদাতা মোগল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবরের শুরু করা দিন গণনা’র এই আয়োজনে মেতে উঠি আমরা ভয়াবহ রকমে। পহেলা বোশেখের ভোরে লালপাড় সাদাশাড়ি এবং পা’জামা পাঞ্জাবি পরে আমরা, অতি আধুনিক বাঙালিরা সমবেত কন্ঠে কোরাস তুলি-

<em>এসো হে বৈশাখ এসো এসো।
কিছুক্ষণের জন্য পাশে বসো...</em>

আমি দু:খিত, দ্বিতীয় লাইনটি আমার বানানো। অটা সুর করে গাওয়া হয় না। লাইনটির ধারণা কোথ্যেকে পেলাম, সেটা বলি।

যখন এই চরণগুলো গাওয়া হয়, তখন অবচেতন মনের অবস্থা থাকে এমন, এসো হে বৈশাখ এসো এসো। সারাদিন থাকো আমাদের সাথে। খাতির-যত্নের কমতি হবে না। সন্ধ্যেবেলা আবার চলে যাও! আমরাও ফিরে যাবো আমাদের অতি প্রিয় পশ্চিমা সংস্কৃতিতে। তোমাকে দিয়ে আমাদের পোষাবে না। কেনো বুঝতে পারছো না যুগ পাল্টেছে। একুশের এই আমরা মেতে থাকবো জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি নিয়ে। তবে বছরে একবার তোমাকে ঠিকই স্মরণ করবো। চিন্তা করো না।

তুমি কিছু মনে করোনা প্রিয় বৈশাখ। তুমি তো আমাদের আপনজন। তোমাকে আমরা আমাদের চেতনার বন্ধ কুটিরে যত্ন করেই রাখবো। সযত্নে তুলে রাখবো আমাদের অস্তিত্বের পাণ্ডুলিপিতে।

 এক সময়, কোনো এক সময় আগামী প্রজন্মের কৌতূহলি কেউ জমে থাকা ধূলো-ময়লা ঝেড়ে বের করবে পাণ্ডুলিপিটি। ততক্ষণে আমরা হারিয়ে যাবো কালের গহীনে। সেখান থেকে দেখবো, চেতনার বৈশাখকে তারা বাস্তবতার বৈশাখে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। সে পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষায় থাকতে হবে প্রিয়। আমাদের ক্ষমা করো। বুঝতেই পারছো সব কাজ সকলের দ্বারা হয় না।

দুই

বৈশাখকে কেন্দ্রকরেই আমাদের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতি। অথবা বাংলাদেশি। আচ্ছা আমরা কি বাঙালি? নাকি বাংলাদেশি? নাকি দু’টোই?

বাঙালি হই আমরা, কিংবা বাংলাদেশি, কী আসে যায়! আমাদের হাড্ডিসার শরীরে বাঙালির পোশাক পরানো হোক অথবা বাংলাদেশির, যেমন আছি তেমনই তো থাকতে লাগবে। অনেকটা লোহার মতো। লোহাকে যত বড় হাতুড়ি দিয়েই পেটানো হোক, লোহা লোহাই থাকে, স্বর্ণ হয়ে যায় না।

আমাদের অবস্থাও তাই। ৫ বছর আমাদের ঘাড়ে পড়বে বাঙালি হাতুড়ির বাড়ি, পরের ৫ বছর বাংলাদেশি হাতুড়ির। যে হাতুড়ির মাথায় লাগানো থাকে হরতাল,অসহযোগ,জ্বালাও, পোড়াও কিংবা ঘেরাও। আমরা জ্বলতে থাকি। আমরা পুড়তে থাকি। হাতুড়ির আঘাত আমরা সহ্য করতে থাকি। সহ্য আমাদের করতেই হয়। চিৎকার করে কাঁদতেও পারিনা আমরা। সেই অধিকার আমাদের নেই। আমরা আমাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও সুখ-দু:খের ৫ বছর মেয়াদি ঠিকা দিয়ে দিই গুটি কতেক লোকের হাতে। তারা দয়া করে আমাদের হাসতে বললে আমরা হাসবো, কাঁদতে বললে কাঁদবো, ব্যস। তাহলে অহেতুক বিতর্কের পেছনে ছুটে দরকার কি!

থাকুক অসব কথা। বাঙালি-বাংলাদেশি নিয়ে মাথা আমরা না ঘামালেও চলবে। আমরা বরং ওয়ানটাইম বাঙালিদের নিয়ে কথা বলতে পারি।

যে কোনো দিন, টিএসসি মোড়, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফ্যান্টাসি কিংডম অথবা দেশের বিশ্ববিদ্যালযগুলোর সোনালি বিকেল। ঘুরে আসুন একবার। রং উঠা ছেড়াফাড়া জিন্স, টি-শার্টে আবিস্কার করবেন শতশত মানুষ। কপাল কিংবা মাথায় সানগ্লাস, গলায় চেইন, হাতে ব্রেসলেট, কানে দুল। মানুষ বললাম কারণ, আমি ১০০ টাকা বাজি রেখে বলতে পারি, বাহ্যিক দৃষ্টিতে আপনি চিনতে পারবেন না এদের মধ্যে কারা তরুণ আর কারা তরুণী! আলো-আঁধারির নীলাভ মিলনমেলা চায়ানিজ যাদের লাঞ্চ কিংবা ডিনারের ঠিকানা। ড্যাডি-মাম্মিতে অভ্যস্ত এই প্রজন্ম কখনো যদি-বাবা-মা কারে কয়, এই প্রশ্নও করে বসে, অবাক হবার কিছু থাকবে না।

তাই বলে এরা যে পশ্চিমা মোহে পড়ে বাঙালি সংস্কৃতি একেবারেই ভুলে গেছে, এটা ভাবলে ভুল হবে। এটা প্রমাণ করবার জন্যে পহেলা বৈশাখ তো রয়েছেই। পহেলা বৈশাখে আমাদের তরুণ-তরুণীরা প্রচন্ড আবেগ নিয়ে এসে জড়ো হয় রমনা বটমূলে। হিন্দি ছবির অর্ধেকটা দেখে বাকি অংশ গিয়ে দেখবার নিয়ত করে চলে আসে বাঙালিত্বেরই টানে! যে টান হৃদয়ে লালিত হবার কথা, অতি আবেগে সেটা কখনো কখনো চলে আসে হাতে। মাঝেমধ্যে কিছু হাত আবার চলে যায় কোনো ওড়নার সন্ধানে! অতি বাঙালিত্বের উন্মাদনায় ওরা ভুলে যায় এমনি এক নিউ ইয়ার সেলিব্রেটের রাতের সাথেই জড়িয়ে আছে বাধন'দের আর্তচিৎকার। সাথে বিকারদের পৈশাচিক হাসি। এতো ভুলো মন কেনো আমাদের!

পহেলা বৈশাখের ভোরে বর্ষবরণের আঙিনায় স্বাগত আপনাকে।
 কিছুক্ষণের জন্য চোখ জুড়িয়ে যাবে আপনার। অতি আধুনিক মানুষগুলোকে আবিস্কার করবেন খাটি বাঙালি পোশাকে। লাল পাড় সাদা শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি-পা’জামা পরা মানুষ। স্যান্ডউইচ বা বার্গার না, তাদের সামনে দেখবেন আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির সানকিতে পান্তার ফাঁকে চিকচিক করছে পদ্মার ইলিশের ঝোল।

পিঁয়াজ ও কাঁচামরিচে তৃপ্তির কামড় দিয়ে চোখে মুখে এমন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে, যেনো অমৃতের ঝরনায় সবেমাত্র গোসল করে উঠলো তারা! যদিও অনভ্যাসের কারণে সন্ধ্যেবেলা তাদেরকে আবার ভিড় জমাতে দেখা যায় পাশের ফার্মেসিগুলোতে, ওরস্যালাইনের খুঁজে। সেটা ভিন্ন ব্যপার।

আমরা মনে করি, সারা বছর যারা ডুবে থাকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে। বাংলা নববর্ষের আঙিনায় জড়ো হবার কোনো অধিকারই তাদের নেই।

এদেশের অসহায় মানুষ ঘরের চালের ছিদ্র এবং তাদের চোখ দিয়ে একই সাথে টপ টপ করে পড়তে থাকা পানিতে ভিজে স্যাঁতসেত মেঝেয় বসে পান্তা খায় লবন ও মরিচ মাখিয়ে। ইলিশের গন্ধ তাদের কল্পণাতেই তাকে শুধু। অরা পান্তার আশ্রয় নেয় বেঁচে থাকবার জন্যে। অসহায় মানুষের কষ্টের অংশিদার  না হতে পারি, সেই গরিবের খাদ্য নিয়ে এই ধরনের উপহাস করবার কোনো অধিকারই কারো নেই।

সারা বছর চায়নিজ-থাই খাবার খেয়ে আপ মডেলের মার্সিটিজ-বিএমডব্লিউ হাঁকিয়ে পহেলা বৈশাখ চলে আসবেন বটমূলে! বাঙালি হতে! এটা তো মানবিক অপরাধের পর্যয়ে পড়ার কথা। যেমন আছেন, যেভাবে আছেন, তাই থাকুন। একদিনের বাঙালি হবার দরকার কি??

আমরা আশা করতে চাই, ৩০মে চৈত্র ১৪১৮’র সাথে সাথে আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিক আমাদের মনের ভেতরের যত আবর্জনা। বিদায় নিক যত শঠতা। বিদায় নিক বর্তমান নিয়ে, আগামী নিয়ে যত সংশয়।

পহেলা বৈশাখ আসুক। থাকুক আমাদের সঙ্গে, আমাদের স্বরণ করিয়ে দিতে, আমরা বাঙালি। আচ্ছা আমরা কি শপথ নিতে পারিনা, বাঙালি হবার!
কথায় তো হয়েছি।
কাজে হবার???

বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১১

বাদশা নামদার, জনাবে আ’লা: যদি কিছু মনে না করেন...!!!

  বাংলাদেশের বহুধাবিভক্ত উলামায়ে কেরামের ছোট্ট একটি অংশের সিংহাসনের মালিক, একলা চলো নীতি’র ধারক মুফতি ফজলুল হক আমিনী’র ডাকে ৪ঠা এপ্রিল সারাদেশে পালিত হলো সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। কীভাবে কী হলো, অথবা যেভাবেই যা হোক, হরতাল সফল হয়েছে। সরকারকে এই ম্যাসেজটি পাঠানো গেছে, পানক সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর  খাহেশ থাকা ভালো না! সরকারের থিংক ট্যাংক বোধকরি ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, আলেম সমাজের ছোট্ট একটি অংশের ডাকা হরতালের চেহারা যদি এমন হয়,  সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে, রাস্তাঘাট হয়ে যায় যান শূন্য,  তাহলে আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি হরতাল আহবান করলে কী হবে অবস্থা! তখন রাস্তায় একটি পিঁপড়াও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না- বলা মুশকিল!
মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে সরকারকে একটি সু-সংবাদ দিতে চাই আমি। বলতে চাই, আমার কথায় খামাখা ভয় পেয়ে টেনশান করে প্রেসার হাই করার দরকার নেই। এদেশের আলেম-উলামা বিচ্ছিন্ন থেকে থেকে প্রয়োজনে শহীদ হয়ে যাবেন তবুও ঐক্যবদ্ধ হবেন না। সব ভুলে একটি মাত্র ব্যানারের পেছনে তাঁরা কোনোদিনই জড়ো হবেন না। এই যে আমি ‘তাঁরা’ সর্বনামটিতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করলাম, সম্মানজনক কাউকে উদ্দেশ্য করলে ‘তাঁরা’তে চন্দ্রবিন্দু দিতে হয় বলে, আমাদের উলামা হযরাতগণের মধ্যে এমন কাউকে এবং অনেককে আমরা পরিচয় করিয়ে দিতে পারি, যারা পরস্পরের জন্য এই সামান্য চন্দ্রবিন্দুটুকু পর্যন্ত ব্যবহার করার মতো উদার হতে পারেন না!  সুতরাং সরকার! নো টেনশান! নিশ্চিত থাকতে পারেন।
দুই\
এবার হরতালের কাহিনী বলি।
বলা নেই, কওয়া নেই, নিজস্ব ব্যানারে হুট করে একটি হরতাল ডেকে বসলেন মুফতি আমিনী! যদিও আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সার্বজনীন ইস্যু, নারী নীতি, ফতওয়া বিরোধী রায় বাতিল ও শিক্ষানীতি’র ইসলাম বিরোধী ধারা বাতিলের দাবিতে ছিলো এই হরতাল। কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে কথা বললে বা আন্দোলন করলে তো লাভ হবে না। আমিনী সাহেবের সিনিয়ার আলেমরা অনুরোধ জানালেন। হরতালটি স্থগিত করেন। আলাদা করে কর্মসূচি দিয়ে পরিবেশ ঘোলাটে করা ঠিক না। যা করার, ঐক্যবদ্ধভাবেই করা দরকার। আমিনী সাহেব সিদ্ধান্তে অনড় ! হরতাল হবেই। হাল ছেড়ে দিলেন বাকিরা। একজন না মানলে কী আর করা!
আমরা, সাধারণ মুসলমান পড়লাম বিভ্রান্তিতে! আজ দেখি, অমুক আলেম পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলছেন, এই হরতালে আমাদের সমর্থন নেই। আবার হরতালের পক্ষে আলেম-উলামাদের সমর্থনের চার রঙা বিজ্ঞাপনে তাঁদের নামও শোভা পায়! আমরা বুঝতে পারিনা কোনটি সত্য আর কোনটি তথ্য বিভ্রাট! ফলে হরতালকে ঘিরে ক্রমেই জমাট বাধতে থাকে বিভ্রান্তির বিব্রতকর ধোঁয়া।
 এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ উলামায়ে কেরামকে মন থেকে ভালোবাসে। তাঁরা কোনো অবস্থাতেই চায়না আলেমদের সম্মান ভূলন্ঠিত হোক। হতাশ হয়ে পড়লো এরা। হরতাল ডেকেছেন মুফতি আমিনী। সারা দেশে আমিনী সাহেবের ক’ডজন কর্মী আছে, আঙুলে গুনেই বলে দেয়া যাবে। তাহলে হরতাল সফল করতে মাঠে নামবে কারা? আবার হরতাল ব্যর্থ হলে লোকে বলবে, মোল্লাদের হরতাল ব্যর্থ হয়েছে!  কেউ মানেনি!  ফলে আলেম-উলামার আগামী আন্দোলন হয়ে পড়বে গুরুত্বহীন। উপযোগ কমে যাবে আন্দোলনের। উভয় সংকট বলে যে একটা সমস্যা আছে, আলেমরা ভোগতে শুরু করলেন সেই সমস্যায়। আর সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কোথাকার পানি কোন দিকে গড়ায়, দেখবার জন্যে।
হরতাল ৪ এপ্রিল সোমবার।  হরতালের আগের দিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হলো যশোরের ছেলে হুসাইন। ১৯ বছরের এই মাদরাসা ছাত্র ভাইটি আমার অংশ নিয়েছিলো হরতালের প্রচার মিছিলে। হুসাইনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নি:¯প্রাণ হরতাল সাফল্যের সুবাস পেতে আরম্ভ করলো। মুখ রক্ষা পেলো মুফতি আমিনীর। ইজ্জত রক্ষা হলো উলামায়ে কেরামের। আর এই হরতাল প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয়া অনেকগুলো প্রশ্ন  আগামীর জন্য থেকে গেলো অমীমাংসিত আকারেই।
তিন\
এবারে কিছু কঠিন কথা বলতে যাচ্ছি আমি। অনেকেই নাখোশ হবেন জানি। তিরোস্কারের তীর ছুড়ে দেবেন আমার দিকে। সমস্যা নেই। বুক পেতে নেবো । লোকচুরি খেলাকরে অভ্যস্ত কেউ কেউ আবার তাকাবেন ৯০ ডিগ্রি বাঁবা চোখে। সমস্যা নেই। গায়ে মাখবোনা কিছু।  কঠিন সত্য বলবার জন্য কিছু মানুষের চামড়াকে করে ফেলতে হয় গন্ডারের চামড়া। গন্ডার হতে আমার আপত্তি নেই। সিংহ শাবকদের ভেড়ার পাল থেকে বের করে নিয়ে আসতে, জাগিয়ে তুলতে, শুধু গন্ডার কেনো, মহা গন্ডার হতেও আপত্তি নেই আমার।
হরতাল ৪ এপ্রিল। ৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭ টায় সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে  আড্ডা দিচ্ছি। আড্ডার বিষয়: যশোরে মাদরাসা ছাত্র হত্যা। তখন এক সাংবাদিক বন্ধু আফসোস করে বললো, আমরা অবাক হচ্ছি রশীদ ভাই! এখানে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছি আমরা। কিন্তু আজ তো আমাদের এভাবে রিলাক্সড হয়ে বসে থাকার কথা ছিলো না! বিনা অপরাধে একটি ছাত্রকে গুলি করে মেরে ফেললো পুলিশ। কওমী মাদরাসার ছাত্রকে। সারা দেশে কয়েক লক্ষ কওমী ছাত্র আছে না! ওরা কোথায়? এখন তো সারা দেশ বিক্ষোভে দিশেহারা হয়ে যাবার কথা ছিলো। আমাদের হিমশিম খাবার কথা ছিলো সংবাদ কভার করতে করতে। ব্যাপার কী? কিছুই তো বুঝলাম না! আমিনী সাহেব কেমন আন্দোলন করছেন!
মনটা খারাপ করে বেরিয়ে এলাম আমি।  ইসলামী ভাবধারার সাথে সম্পর্কহীন একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক, ধর্মীয় পরিচয়ে যে আবার মুসলমানও না, সেই বন্ধুটির মাঝে আমি যে মানবিক অনুভূতির জাগরণ লক্ষ করলাম, তার ছিটেফোটাও দেখা গেলো না আলেম-উলামাদের মাঝে। ভীষণ রকম খারাপ হয়ে গেলো মনটা। প্রায় নির্ঘুম একটি রাত পার করলাম।
      হরতালের দিন, সারাদিন ঘুরে বেড়াতে হয়েছে আমাকে। পেশাগত কারণেই। রাস্তায় বেরিয়ে বিস্মিত হলাম আমি! রাজপথ মাদরাসা ছাত্রদের দখলে।  ঘুরে ঘুরে, সিলেট শহরের অলি-গলিতেও দেখলাম একই দৃশ্য। এদের বেশিরভাগই মুফতি আমিনীর সমর্থক না। এদের অনেকেই রাজনীতি থেকেই নিরাপদ দূরে থাকতে পছন্দ করে।  তবুও তারা মাঠে। কারণ কী?
মুহুর্তেই বিষয়টি ক্লিয়ার হয়ে গেলো আমার কাছে। মুরব্বীরা হুসাইনের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেও ছাত্ররা পারেনি।  ভ্রাতৃত্বের টানে বেরিয়ে এসেছে তারা। স্বাভাবিক কারণেই মনটা ভরে গেলো কানায় কানায়।  চোখ দু’টো ভিজে উঠলো। এক ভাইকে মেরে ফেলেছে, অন্য ভাই ঘরে বসে থাকতে পারে না। থাকেও নি।  খোঁজ নিয়ে জানলাম, বাংলাদেশের হাজার হাজার কওমী মাদরাসার এদিনের চেহারা ছিলো ভিন্ন।  ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে এসেছে ছাত্ররা। বাধ ভাঙা জোয়ারের মতো। ছাত্রদের এই আবেগের পথে মাদরাসা কর্তৃপক্ষও, যাদের অধিকাংশই হরতালের সাথে ছিলেন না, বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বেরিয়ে আসতে দিয়েছেন। সময়ের তাক্বাজাকে চমৎতার দক্ষতায় বিশ্লেষন করতে পারায় উস্তাদদের প্রতি আমাদের বিনম্র সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা। 
হরতাল পর্যবেক্ষণ করতে যেয়ে প্রতিটি ছাত্রের চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলতে দেখেছি আমি। তাদের বেদনামলীন চেহারার দিকে তাকিয়েছি। চেষ্টা করেছি তাদের মনের ভাষা পড়তে। তাদের অনুচ্চারিত বিক্ষোব্ধ হতাশার কথা জানতে। যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি আমি, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। তাদের ভেতরের মানুষগুলো চিৎকার করে বলছে, আমার ভাইকে মেরেছিস! মার, আমাদেরকেও মার। কতো রক্ত চাই তোদের? নে। আমরা বুক পেতে দিতে এসেছি। আমার ভাই যে অপরাধ করেছিলো, আমরাও সে অপরাধ করছি। জেনে-বুঝেই করছি।  মার আমাদের। কর গুলি। আর না হলে জবাব দে, আমার ভাইকে মারলি কেনো??
পুলিশ জবাব দিতে পারেনি। জবাব যে তাদের নিজেদেরও জানা নেই। সরকারও নিরব! জবাব নেই সরকারের কাছেও।  জবাব দিলো গরিব রিক্সাচালক, তাঁর রিক্সাটি বন্ধ রেখে। জবাব দিলো গরিব ভ্যান চালক, তার ভ্যানটি বন্ধ রেখে। জবাব দিলো গলির মোড়ের পান দোকানী, তাঁর দোকানটি বন্ধ রেখে। সাধারণ মানুষ জবাব দিলো হরতাল সমর্থন করে। আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সাধারণ মানুষ হরতালের পক্ষে থেকেছে কুরআনের সম্মানে। আর মাদরাসা ছাত্ররা সারাদিন রোদে পুড়ে না খেয়ে রাজপথে অবস্থান করেছে তাদের ভাই হুসাইনের জন্য। আর এই ফাঁকে সফল হয়ে গেলো আমিনী সাহেবের হরতাল। হিরো হয়ে গেলেন মুফতি আমিনী। আর যা হোক, যেভাবেই হোক, রক্ষা পেয়ে গেলো উলামায়ে কেরামের ভাবমূর্তি।
চার\
চার তারিখের হরতাল সর্বাত্বক সফল হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে স্বস্থি পেয়েছি আমি। আলেম সমাজ বেঁছে গেছেন বেইজ্জতি থেকে। কিন্তু এভাবে তো আর চলে না। আন্দোলন করতে হলে তো সু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে লাগবে। আন্-ডিসিপ্লেন্ড্ কাজ আর উদ্দেশ্যহীন ছুটন্ত ঘোড়ার মাঝে খুব কিছু ব্যবধান নেই তো ।  দায়িত্বহীনতা আর কান্ডজ্ঞানহীনতার মাঝে ফারাকও নেই । আমাদের নেতৃবৃন্দের লিডারশিপ কোয়ালিটি আরো ডেভেলপ করার দরকার আছে কিনা, ভেবে দেখা দরকার। প্রতিটি কর্মীকে নিজের সন্তান ভাবতে হবে। তবেই না সেটা ইসলামী আন্দোলন।
 কেনো বলছি এ কথা!
যাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন দিলো হুসাইন, খুব খারাপ লেগেছে আমার, যখন জেনেছি, সেই মহান নেতাদের একজন কেউ ছেলেটির যানাজায় পর্যন্ত গিয়ে শরীক হবার সময় পাননি!। কেনো? একটি জীবনের মূল্য কি এতই কম?  কেনো যাননি কেউ? পরদিন হরতাল, তাই ব্যস্ত ছিলেন। আরে ! যে ছেলেটির জীবন উৎসর্গিত না হলে মাঠে মারা যেতো হরতাল, শুকরিয়া আদায় করার জন্য হলেও তো তার যানাজায় হাজির হওয়া উচিৎ ছিলো। মুফতি আমিনী সাহেবের কাছে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারলে ভালো হতো। এই ছেলেটির বাবার নাম যদি হতো মুফতি ফজলুল হক আমিনী, তাহলে কি কোনো ব্যস্ততা আটকে রাখতে পারতো তাঁকে! কী বলেন মুফতি ওয়াক্কাস সাহেব? আপনাকেও বলছি।


হরতাল পালিত হলো ৪ঠা এপ্রিল। ৬ এপ্রিল  দেশের শীর্ষ আলেম, আলেম সমাজের আস্থার প্রতীক, আল্লামা আহমদ শফী’কে আমীর করে গঠিত হলো সর্বদলীয় ইসলামী ঐক্য পরিষদ।  দলমত নির্বিশেষে দেশের সবগুলো ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করলেন। উপস্থিত হলেন মুফতি আমিনীও। সভা’র শুরুতেই ৪ তারিখের হরতালের ব্যপারে নিজের অবস্থান ব্যখ্যা করলেন আহমদ শফী। বললেন, হরতালের সমর্থনে আমার কোনো বিবৃতি ছিলো না। আমার নামে পত্রিকায় বিবৃতি গেছে অথচ আমার সাথে কোনো যোগাযোগই করা হয়নি! আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখার পূর্ণ সুযোগ থাকা সত্তেও কপট রাগ দেখিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করলেন আমিনী সাহেব। এ কেমন আচরণ!
এরপর একে একে বেরিয়ে আসতে লগলো এমন আরো অনেক কিছু। দেখাগেলো, যে সব উলামা-মাশায়েখের নাম ব্যবহার করে পত্রিকায় বিবৃতি পাঠানো হয়েছিলো বিজ্ঞাপন আকারে, তাদের অধিকাংশই  জানেন না ! আমিনী সাহেব আলেম-উলামাকে ইমোশনাল ব্লাকমেল করেছেন।
আমি ছোট মানুষ। হাত বাড়ালেই আমিনী সাহেবের মতো বড় নেতাকে নাগাল পাবো না। কেউ কি তাঁকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন,  নিজের ইমেজের প্রতি তাঁর এতই যদি আস্থাহীনতা, বাস্তব উপলব্দি যদি এতই প্রখর হয়ে থাকে, তিনি যদি বুঝতেই পারেন, আমার একা’র আযানে মুসল্লি পাওয়া যাবেনা, তাহলে তিনি একা থাকেন কেনো?
সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন, আলেম-উলামা তো আপনাকে প্রাপ্য মর্যাদাসমেত সাথে নিয়েই কাজ করতে চান। আপনি সবসময় ডিগবাজি দিয়ে সরে যান কেনো?  নেতা তো আপনি আছেনই। একক নেতৃত্ব চান? আর এজন্য একলা চলো নীতি?  স্বীকার করছি আপনি বড় আলেম। কিন্তু  যদি ভাবেন আপনিই বাংলাদেশের একমাত্র আলেম বা সবচে’ বড় আলেম, আপনার উপরে আর কেউ নেই বা থাকতে নেই, তাহলে তো সেটা হবে বালখিল্যসুলভ ভাবনা।

পাঁচ\
আন্দোলনের ডাক দেবেন। তা মুফতি আমিনী হোন আর অন্য যে-ই,  ছেলেরা রাস্তায় নামবে। কষ্ট করে আন্দোলন সফল করে দেবে। পুলিশের মার খাবে। গুলি খেয়ে মারা যাবে। যানাজায় পর্যন্ত যাবেন না। সন্তানহারানো বাবা লোকটির কাধে শান্তনার হাতটি পর্যন্ত রাখবেন না। এ জন্য পঞ্জিকা দেখে তারিখ ঠিক করবেন। কেমন করে হবে?
      ছেলেরা রাস্তায় নামবে। পুলিশ তাদের পেঠাবে গরু-ছাগলের মতো। মেরে হাত-পা ভেঙে দেবে শত শত ছেলের। যন্ত্রণায় কাতরাবে ছেলেগুলো। ফিরেও তাকাবেন না। তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন না। তাহলে তো হবে না।
      পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে আরো কয়েকশ’। মামলা হবে তাদের বিরুদ্ধে।  নেতারা গা ছাড়া ভাব দেখাবেন। ছেলেদের ছাড়িয়ে আনতে তড়িৎ উদ্যোগ নেবেন না। তাহলে কীভাবে হবে?
হরতালের আগে মাইকিং করতে থাকা ছয়টি ছেলেকে ধরে নিয়ে গেলো পুলিশ। আমি মুক্তাগাছার কথা বলছি। সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত হাজতে কাটিয়ে এরো তারা। কিন্তু সারাটা দিন ছেল্গেুলো কিছু খেলো কি না-খোঁজ নেয়নি কেউ। জেনেই বলছি আমি। কেউ একজন নেতা একটি কলা বা পাউরুটি নিয়েও যাননি। ভুল বুঝবেন না আবার। ভাববেন না তারা ব্যস্ত ছিলেন ছেলেদের জেল থেকে বের করার কাজে। এতো দরকার নেই তাদের। ঢাকা থেকে একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক, আমার অগ্রজ বন্ধু অনেক চেষ্টা-তদবীর করে ছেলেগুলোকে ছাড়িয়ে আনেন।  এ কেমন অবস্থা?
ছয়\
মূল যে ইস্যুটি নিয়ে ছিলো এই হরতাল, নারী নীতি, সেটা নিয়ে অনেক কিছু বলবার দরকার আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। আলেমরা বলছেন, কুরআন বিরোধী কোনো আইন করতে দেয়া হবে না। সরকার বলছেন, কুরআন বিরোধী কোনো আইন আমরা করবোও না। তাহলে মৌলিক ক্ষেত্রে দূরত্ব তো নেই। নারীনীতি দেখা আছে আমার। শব্দের মারাতœক মারপ্যাঁচ রাখা হয়েছে। এখন, সরকার যেহেতু বলছেন, নারী নীতিতে সম্পদ বলতে উত্তরাধীকারের কথা বুঝানো হয়নি, তাহলে সামান্য একটি পদক্ষেপ নিলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একটি মাত্র বাক্য যুক্ত করে ফেললেই হয়। আলেমরাই বা কেনো এই প্রস্তাবটি করছেন না। বাক্যটি হতে পারে এমন: মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী নারীর প্রাপ্য সম্পদে নারীর পূর্ণ অধীকার নিশ্চিত করা হবে। ব্যস, তাহলেই তো হয়ে যায়।
ইদানিং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা করছেন তাফসীর স্টাইলে। আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। যে দেশের প্রধান নির্বাহী কুরআন শরীফের আয়াত নাম্বার বলে বলে জনসভায় বক্তৃতা করেন, সেই দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম হতে খুববেশি মনে হয় বাকী নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মূল্যবান তাফসীর শুনে আরেকজনের তাফসীর মনে পড়ে গেলো। একলোক ঘোষণা করলো নামাজ পড়ার দরকার নাই। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নামাজের কাছেও যেওনা’। তাকে বলা হলো, অই ব্যাটা, এই গাঁজাখুরি তথ্য তুই কোথায় পেলি? সে বললো, কেনো! পবিত্র কুরআন শরীফেই তো আছে। বলা হলো, চল দেখি তোর কোন কুরআন শরীফে এ কথা লেখা। সে কুরআন শরীফ খুলে দেখালো। লোকেরা দেখলো সত্যিই লেখা-‘হে ঈমানদারগণ তোমরা নামাজের নিকটবর্তীও হয়োনা’। লোকেরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ী করতে লাগলো। পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব কোথায় জানি দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। তিনি এসে দেখলেন ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, অই ব্যাটা! পৃষ্ঠা উল্টা। পৃষ্ঠা উল্টানো হলো। আয়াতের বাকী অংশ হচ্ছে ‘নেশাগ্রস্থ অবস্থায়’। অর্থাৎ ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা নামাজের কাছেও যেওনা নেশাগ্রস্থ অবস্থায়’।
আমাদের নেত্রীকে যারাই আয়াত সাপ্লাই দেন, তারা তাদের জন্য সুবিধাজনক অংশগুলোই কেবল নেত্রীর সামনে হাজির করেন। নেত্রী দেখেন, আরে! আল্লাহ তো দেখছি আমাদের মতোই বলছেন। তাহলে মাওলানা খামাখা চিৎকার করছে কেনো? আমরা বলি বাদশা নামদার। এ ব্যাপারে আরেকটু সিনসিয়ার হওয়াটাই কি ভাল না? এদেশের পোড় খাওয়া আলেম-উলামা পবিত্র কুরআনের একটু আধটু তরজমা তাফসীর করেই দিন কাটান। তাদেরকে বেকার করে দেয়া কি ঠিক হবে।
জনাবে আ’লাকে বলি, টেবিল টকিং এর মাধ্যমে বিষয়টি শুরাহার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। আর আন্দোলনে গেলে, ছেলেদের দায়দায়িত্ব নিন। আর সম্ভব হলে একলা চলো নীতি ত্যাগ করে মুরব্বীদের সাথেই থাকুন। 

সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০১১

হরতালের পোষ্ট মর্টেম



আমরা কী করছি? আমরা কি সঠিক পথে এগুতে পারছি? সব ঠিক আছে আমাদের? আমরা কি দায়িত্বশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারছি? আমার তিক্ত কথাগুলো হয়তো অনেকেরই পছন্দ হবেনা। তাতে কি! আমি তো আর আমার বোধ'র সাথে প্রতারণা করতে পারি না!


আমি ভাবি, বোধগুলো আমাদের কোথায় হারিয়ে গেলো?  আমার একটি ভাই, কওমী মাদরাসার একটি  ছাত্রকে মেরে ফেলা হলো গুলি করে, আমরা সেভাবে গর্জে উঠতে পারলাম না যেভাবে পারা উচিৎ ছিলো!  

যে যে দলই করুন, কওমী মাদরাসাগুলোর তো এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে নিরব বসে থাকার কথা ছিলো না! আমি যশোরের হুসাইনের কথা বলছি। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দুর্ভাগ্যজনক নিরবতা আমাদের কষ্ট দিয়েছে খুব!


 অবশ্য মুরব্বীরা বসে থাকলেও বসে ছিলোনা দেশের কওমী ছাত্ররা। ভ্রাতৃত্বের টানে গতকাল তারা বেরিয়ে এসেছিলো রাস্তায়। তাদের মাঝে একটি অনুভূতিই কাজ করছিলো। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে, আমরা বসে থাকতে পারি না! 

৪এপ্রিল সারাদেশে হরতাল হয়েছে। মোটামুটি সফল হরতাল, বলাই যায়! এর প্রধান কারণ ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ছাত্ররা স্বতঃস্ফুর্তভাবে নেমে এসেছিলো রাজপথে। কে হরতাল ডেকেছেন, সেটা কোনো ব্যাপার ছিলো না।
আমাদের কথা হলো,  হরতালের আগের দিন যশোরে যে ছেলেটি মারা গেলো ,কিশোর ছেলেটি, আমার ভাইটি, তার কী হবে? আল্লাহর কাছে সে শাহাদাতের মর্যাদা পাবে, ঠিক আছে। নেতাদের কাছ থেকে সে কী পেলো? কেন্দ্র থেকে নেতারা কি কেউ গিয়েছিলেন ছেলেটির বাবা-মা'র কাছে? 
যাওয়া কি উচিৎ ছিলো না?
শান্তনার হাতটি রেখেছিলেন পুত্রহারানো বাবা লোকটির কাধে? 
রাখা কি উচিৎ ছিলো না?

হুসাইন নামক ভাইটি আমার মারা গেলো কোরআনের জন্য। সে ভাগ্যবান। দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা তাকে সামান্য সম্মানটুকু জানাতে পারলাম না ! গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের মতো আমরাও  কি ব্যবহার করলাম  হুসাইনকে! তার লাশকে ব্যবহার করলাম হরতালের ঢাল হিসেবে??

কেনো বলছি এ কথা?
কারণ, আমি যদ্দুর জানি, হরতাল আহবানকারী কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউই ছেলেটির জানাজায় পর্যন্ত গিয়ে শরীক হননি!
কেনো?
একটি জীবনের দাম কি এতই কম?

বললে বোধ’য় অত্যুক্তি হবে না বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি এবং কওমী মাদরাসা একটি অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অভিন্ন সাবজেক্ট। একটির গায়ে আচড় লাগলে ব্যথা অনুভূত হয় অন্যটির শরীরে। হবারই কথা। এদেশে ইসলামী রাজনীতির মূল উপকরণ ধরা হয় কওমী মাদরাসার ছাত্রদের।

ইসলামী সংগঠনের আলেম নেতারা সভা ডাকলে পোস্টারিং মাইকিং এর কাজগুলো তো এদেরই করতে হয়। হরতাল টাইপ আন্দোলনের ডাক দিলে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পুলিশের কাঁদানো গ্যাস ও লাঠিপেটা খেয়ে আন্দোলন সফল করবার জন্য মাঠে তো নামতে হয় এই কওমী মাদরাসা ছাত্রদেরই। এরা হলো রিজার্ভ ফোর্স।

এত ব্যবহার করি আমরা ছেলেগুলোকে, অথচ তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ভিশন সেট করতে চাই না। কখনো কি ভেবে দেখেছি এই ছাত্রগুলোর  প্রতি আমরা সুবিচার করতে পারছি কি না!

মুফতি আমিনি সাহেবের ডাকে সারা দেশে হরতাল পালিত হলো। যদিও দেশের সকল শীর্ষ আলেম-উলামা হরতাল সমর্থন জানাননি। কিন্তু  রাজপথে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র! দলমতের উর্ধে উঠে আলেম-উলামা এবং কওমী মাদরাসা ছাত্ররা নেমে এসেছিলেন মাঠে।
কেনো?
আমিনি সাহেবের সম্মানে?
মুফতি আমিনিকে সফল নেতা বানানোর জন্যে?
মোটেও না।
কেনো তবে??
কারণ, উলামায়ে কেরামের বর্তমান অবস্থান ও প্রশ্নবিদ্ধ আগামী আরো যাতে ছন্নছাড়া হয়ে না যায়, মানুষ যাতে মনে না করে, আলেমদের হরতাল  ব্যর্থ হয়েছে, আলেমরা ব্যর্থ হয়েছেন, শুধু এই কারণেই ।

আমার প্রশ্ন অন্য জাগায়। নেতাদের কাছে আমাদের জানতে চাওয়া খুবই সামান্য,
গতকালের হরতালে শত শত ছাত্র আহত হয়েছে। এদের চিকিৎসার ভার কে নেবে?
শতাধীক গ্রেফতার হলো। এদের ছাড়িয়ে আনতে কী পদক্ষেপ নেয়া হলো? দায়ছাড়া ছন্নছাড়া নেতৃত্ব দিলে তো হবেনা। 
হরতাল ডাকবেন, ছাত্ররা আহত হবে, চিকিৎসার দায় নেবেন না! তাহলে তো হবে না!

ছেলেরা জেলে যাবে, ছাড়িয়ে আনতে চেষ্টা করবেন না! ঠিক যেভাবে হরতালের আগের দিন মুক্তাগাছা থেকে ৬ জন মাদরাসা ছাত্রকে গ্রেফতার করে সারাদিন আটকে রাখা হলো। কোনো নেতা সারাদিন তাদেরকে ছাড়িয়ে আনতে যাননি! ছাড়াতে যাবেন তো পরের কথা। সারাদিন ছেলেগুলোর জন্য  এক বোতল পানি পর্যন্ত পাঠাননি!! 
এমন হলে তো হবে না!


 অবস্থা যদি এমন হয়, আর তারপরেও ভাবেন,  এই ছেলেরা ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য আজীবন মাঠে থাকবে!! আপনাদের পেছনে পেছনে জিন্দাবাদের স্লোগান দিয়ে দিয়ে মাঠ কাঁপাবে!
তাহলে এই ধারণা ব্যুমেরাং হতে খুব বেশি দিন লাগবে বলে তো মনে হয় না।

রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০১১

তোমার শূন্যতা...

  বায়তুল মোকাররাম জাতীয় মসজিদের মরহুম খতিব মাওলানা উবায়দুল হক রাহ.’র
আত্মার প্রতি নিবেদিত খোলাচিঠি
তোমার শূন্যতা
প্রিয় পূণ্যত্মা। সালাম জানাই। আশা নয়, বিশ্বাস, শান্তিতেই আছেন। থাকবারই কথা। পূণ্যতার সিঁড়ি ভেঙেছেন, জীবনভর, পূর্ণতার চূড়ায় আরোহণ করবেন বলে। যার জন্য ছিলো অস্তিত্ব, জীবনের সূর্যোদয়, শরত-হেমন্ত, সুখ-আনন্দ, কষ্ট-জরা এবং বেঁচে থাকা, তার তুষ্টিতে রাত করেছেন দিন, এশা থেকে ফজর, ফজর থেকে এশা। আজ তাঁকে কাছে পেয়েছেন। অথবা কাছে গেছেন বিশেষ মেহমান হয়ে। ভালো যে থাকবেনই, না বোঝার কী আছে?
প্রিয় খতিব!
আপনাকে লিখছি কেনো?
আল্লাহর পথে যারা জীবন উৎসর্গ করেন, তাদেরকে মৃত বলতে হয়না। যেমন আপনি। বিশেষ জীবনে আছেন। যে জীবনের রুলস্-রেজুলেশন একটু ভিন্ন। জানি আমরা, আপনি এখন আর নিজের অর্জনকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন না। কিন্তু প্রিয়জনদের জন্য অনেক কিছুর তদবির করতে পারবেন। এই সুযোগটি আমরা নিতে চাই। আমরা আপনার প্রিয় তালিকায় পড়ি কিনা- জানি না। হয়তো পড়ি! হয়তো পড়িনা। অবস্থা যেমনই হোক, আজ আমি আমার কথাগুলো আপনাকে বলবোই। এই দৃঢ়তায়, পরম করুণাময় বিশেষ ব্যবস্থায় সেটা আপনার কাছে পৌঁছে দেবেন। তারপর হয়তো তিনিই আবার আপনাকে মর্টিভেট করবেন আমাদের হয়ে তাঁর কাছে চাইতে।
প্রিয় খতিব!
জানতে চাইবেন না আমরা কেমন আছি? কেমন আছেন আপনার সহকর্মী আলেম-উলামা? কেমন আছে আপনার বায়তুল মোর্কারাম? আপনার প্রিয় দেশবাসী?
আমরা ভালো নেই খতিব। মোটেও ভালো নেই আমরা। এ জন্য দায়ী কিন্তু নিজেরাই। আমাদের অহমিকা, একঘেয়েপনা, একদর্শিতা, আত্মবিকৃতি, সিদ্ধান্তহীনতা আমাদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না। সবগুলো বলতে শুরু করলে এতো শান্তির ঠিকানায় থেকেও কষ্ট পাবেন আপনি। আপনার বুকের বামপাশে, হার্ট যেখানটায় আছে, ঠিক তার  নিচেই অনুভব করবেন চিনচিন ব্যথা! তবুও শুনুন! কিছুকথা আপনার শোনা দরকার। আপনার বায়তুল মোকাররাম আজ আর আলেমদের হাতে নেই। যে মিম্বরে দাঁড়িয়ে আপনি খুতবা দিতেন, সেখানে আজ আসন পেতেছেন একজন প্রফেসর! জনশ্র“তি আছে এই ভদ্রলোকের আবার মসজিদ থেকে মাজারের দিকেই বেশি আকর্ষণ।
আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না খতিব। যে বস্তুটিকে আমরা এখন খতিব বানিয়ে বায়তুল মোকাররাম আলোকিত করবার দায়িত্ব দিয়েছি, তার ভেতর-বাইর কতো বেশি অন্ধকার! কুরবানীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কোথাকার কেউ একজন চ্যালেঞ্জ করে বসলো আদালতে। খতিব হিসেবে জানতে চাওয়া হলো তার কাছে। তিনি বললেন, খতিয়ে দেখবো! ক্লাস ফাইভের একটি বাচ্চাও যে মাসআ’লাটি জানে, খতিব সাহেব সেটা খতিয়ে বের করবেন। চিন্তা করেন অবস্থা?
এই ভদ্রলোকের কথা কী বলবো। ফিতরার পরিমাণ জিজ্ঞেস করলে সোজা সেঞ্চুরী করে বসেন। ঈদের নামাজ পড়ান ফিফটি পার্সেন্ট ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ফিফটি পারসেন্ট মানে ডিজিটালের ডিজি বাদ দিয়ে আর কি!
ডিজিটাল বলেতে গিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির কথা চলে আসে। এই লোকের কাহিনী আপনার না শোনাই ভালো। আমি যখন বলবো এই লোক ফাউন্ডেশনের ইমাম সম্মেলনে ব্যালে ড্যান্স করান, তখন আপনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করবেন, ব্যালে ড্যান্স! সেটা আবার কী?
আমাকে বলতে হবে, এটা আমেরিকান মেয়েদের নৃত্য।
তখন আপনি রাগত কন্ঠে জানতে চাইবেন, এই লোককে ফাউন্ডেশন থেকে তাড়ানোর প্রক্রিয়াটি কতটা অপমানজনকভাবে হয়েছে? তখন মাথা নিচু করে বলতে হবে, ডিজি এখনো আছেন বহাল তবিয়তে।  আমরা কিছুই করতে পারিনি! তারচে’ এটা আপনার না শোনাই ভালো।
এমন গুণধর ব্যক্তিদের আমরা বায়তুল মোকাররামে ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে হজম করে চলেছি খতিব। কেউ কিছু বলছি না। না আমজনতা, না আলেম-উলামা। লোক দেখানো প্রতিবাদ অবশ্য হয়েছে। সেটা না হওয়ার মতোই। আলেম-উলামারা দু’একটি বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রসব করে হালকা হয়ে গেছেন।  ভেবেছেন আমাদের আর কী করার আছে। আল্লাহপাকের কাছে নিশ্চয়ই আর জবাবদিহি করতে হবে না!
 আচ্ছা খতিব, বাংলাদেশের আলেম-উলামারা আল্লাহকে বোকা ভাবেন কিনা-এমনটি ভাবলে আমার কি  কোনো গোনাহ হবে? বোকাই যদি না ভাবতেন, তাহলে সামান্য প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল করে কেমন করে ভাবেন দায়িত্ব পালন করা হয়েগেছে। বোধগুলো আমাদের মরেগেছে খতিব। আমরা বেঁচে আছি নির্বোধ জড়পদার্থের মতো। আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন না। ক্ষমা পাবার কোনো অধিকারই আমাদের নেই।
    প্রিয় খতিব!
    বায়তুল মোকাররাম, আমরা জানি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাবে সাথে এ কথাও জানি, দেশের প্রায় আড়াই লক্ষ মসজিদের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে এই বায়তুল মোকাররাম। বিশ্বাস করুন খতিব, বায়তুল মোকাররাম আজ অন্ধকার হয়ে আছে! শত শত বাল্ব জ্বালিয়েও এই অন্ধকার দূর করা যাচ্ছে না। বায়তুল মোকাররামের মতো মসজিদের মিম্বরে যদি থাকেন মেরুদন্ডহীন কেউ, তাহলে অবস্থা যা হবার, তাই হয়। হচ্ছেও।
    জাতীয় মসজিদের মিম্বর থেকে দেশের ১৪ কোটি মুসলমানের হৃদয়ের কথাই উচ্চারিত হবার কথা। কুরআন-সুন্নাহ’র বিরুদ্ধে কোনো কিছু হলে প্রতিবাদের প্রথম আওয়াজটি ওখান থেকেই আসার কথা। আজ যখন সরকার, বুঝে হোক আর না বুঝে, সেচ্ছায় হোক আর বিদেশি মুরব্বিদের চাপে, কুরআনের নির্দেশনার বিপরীতে আইন করে  ফেলতে যাচ্ছে, বায়তুল মোকাররাম তখন নির্বিকার! আমাদের খতিব সাহেব মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। অবস্থা  দেখে মনে হচ্ছে বোমা মারলেও তার পেট থেকে এ ব্যাপারে কোনো কথা বের হবেনা!
    প্রিয় খতিব!
    কী করে পারতেন? বায়তুল মোকাররামের খতিব যুগ্মসচিব পদ-মর্যাদার সরকারি কর্মকর্তার ক্যাটাগরিতে পড়েন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আপনি ছিলেন ব্যতিক্রম। যে কোনো সরকার কুরআন বিরোধী পদক্ষেপ নিতে চাইলে প্রথম হুংকারটি আপনিই দিয়েছেন। সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মিম্বর থেকে নেমে এসেছেন পল্টনে। কী করে পারতেন? এই পবিত্র মনোবল কোথা থেকে পেতেন আপনি?
    প্রিয় খতিব!
    আজ আপনাকে মনে পড়ছে । খুব মনে পড়ছে। আজ ঠের পাচ্ছি আপনার শূণ্যতা! আপনি যখন ছিলেন, বুঝতে পারিনি কী ছিলেন। আজ  নেই যখন, বুঝতে পারছি কী হারিয়েছি।
    আপনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, আমার দেশের ‘নেতা বেশি কর্মী কম’ টাইপ ইসলামী সংগঠনগুলোর অতি অভিজ্ঞ আলেম-উলামারা আপনাকে খুব একটা মূল্যায়ন করতে রাজি হননি।  নিজেরা শুকনো রুটিতে অভ্যস্ত কিন্তু পরের ঘি’তে কাটা বাছতে আমাদের জুড়ি নেই কোনো। আপনি ছিলেন এদেশের আলেম সমাজের আস্থার জায়গা, নির্ভরতার প্রতীক, অবচেতন মানসিকতার নির্ভার মনোবল, অনেক আলেম-উলামাদের কাছেই সেটা ছিলো অজানা! আপনার ব্যক্তিত্ব ও ইমেজকে ব্যবহার করে সফলতার মুখ দেখেছেন আলেমরা। কিন্তু মুখে সেটা স্বীকার করার উদারতা দেখাতে পারেননি।  

এদেশে ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে পরিচালিত সরব আন্দোলনগুলোর  পেছনে আপনি ছিলেন নিরব উৎসাহদাতা। যখন দরকার ছিলোনা, পেছনে থেকে সাহস যুগিয়েছেন। যখন দরকার হয়েছে, সামনে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনি থেকেছেন মূল মঞ্চের বাইরে। সেখানে থেকেই যা যা করা দরকার করেছেন। আপনার নিরব সমর্থনই যে অন্যান্য লাখো কন্ঠের স্লোগানেরচে’ ছিলো শক্তিশালী, এটা যারা বোঝার, তারা ঠিকই বুঝতো। অনেকেই বুঝতেন না। জানি আজও তারা আমার সাথে একমত হতে চাইবেন না। তাতে কি! আমরা তো জানি কে কী! কার দৌড় কতটুকু।
    আমরা ব্যর্থ হয়েছি খতিব। আপনার অবর্তমানে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্র্থ হয়েছি। আমরা আমাদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করছি। মুসলিম জাতির জাতীয় ইস্যুতেও আমরা পারিনি দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধে উঠতে। এখনো আমাদের অনেকগুলো ব্যানার। অনেকগুলো মাইক্রোফোন। দেশের মানুষ উলামাদের হাতে হাত রাখতে চায়। ঐক্যবদ্ধ হাতে। সুযোগ পায়না। কী যে হবে!
প্রিয় খতিব!
শুরুতে বলেছিলাম পরম করুণাময়ের কাছে আমাদের হয়ে সুপারিশ করতে। আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। আল্লাহ’র কাছে আমাদের হয়ে ক্ষমা চাইবার দরকার নেই। আপনিও আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমাদের শাস্তি দরকার। তা না হলে আমাদের হুশ ঠিকানায় আসবে  কেমন করে।


সোমবার, ২৮ মার্চ, ২০১১

শুরু হোক তবে শোষক বিতর্ক

একাত্তরের ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। ঘোষণাটি কে দিয়েছিলেন, সেটা আমি জানিনা! তখন আমার জন্ম হয়নি। যাদের হয়েছিলো, যারা যুদ্ধ করেছেন, তারা সঠিক করে বলতে পারছেন না কিছু! কেউ বলেন অমুক তো কেউ বলেন তমুক! জানিনা কে সত্য বলছেন আর...
কাকে মিথ্যাবাদী বলি! আমরা কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে মিথ্যাবাদী বলে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করতে চাই না।

অবশ্য উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। কেউ গ্রহণ করছেন কেউ আবার প্রকাশ্যেই বিরোধিতা করছেন। আমরা সাধারণ মানুষ পরেছি মহা মুশকিলে। আমরা আমাদের ছোটভাই/বোনদের জানাতে পারছিনা কিছু! তারা যখন জানতে চাইছে, আমরা তখন জবাব দিতে পারছিনা। জবাব জানলে তো!


স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা ঐক্যমত্তে পৌঁছাতে পারিনি স্বাধীনতার ঘোষণাটি কে দিয়েছিলেন? ৫ বছর পর পর ঘোষক পরিবর্তন হন! পৃ্থিবীতে সম্ভবত আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ৫ বছর পর পর ইতিহাস তৈরি করি!


আশ্চর্য আমাদের বিবেক! কে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে এতো পেরেশানি, কিন্তু কেনো দিয়েছিলেন, যে জন্যে দিয়েছিলেন, সেই উদ্দেশ্যটি কি সফল হয়েছে, দেশ কি সার্বিক অর্থে আত্মনির্ভর হতে পেরেছে, না পারলে কেনো পারেনি, কে দায়ী, গলদ কোথায়, শোধরানোর উপায় কি...এগুলো নিয়ে মোটেও ভাবিনা! আবার আমরা স্বপ্ন দেখি এগিয়ে যাবার!!


আর তাই আমরা ভিন্ন পথ ধরতে পারি। আমরা যারা একাত্তর পরবর্তি প্রজন্ম, আমরা ঘোষক বিতর্কে না গিয়ে অন্য বিতর্কে জড়াতে পারি। সেটা হচ্ছে শোষক বিতর্ক। স্বাধীনতার পর থেকেই তো আমরা আম জনতা শোষিত হয়ে আসছি। যাদেরকেই আমরা বিশ্বাস করেছি, ক্ষমতা দিয়েছি, আমাদের বিশ্বাসের পিঠে ছুরি বসাতে তারা কেউই ভুল করেন নি!


আমরা আমাদের বিশ্বাসের আঙুলগুলো তুলে দিয়েছি তাদের মুঠোয়, তারা মুড়িয়ে দিয়েছেন!

আমরা আমাদের আস্থার হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছি তাদের দিকে, তারা হাতটি আমাদের গুড়িয়ে দিয়েছেন!

আমরা আমাদের জীবনের ফায়সালা করবার দায়িত্ব দিয়েছি তাদের কাছে, তারা আমাদের নিয়ে দাবা খেলেছেন! তাদের চৌকস চালে আমরা এক একটি গুটি হারিয়ে গেছি পৃ্থিবী নামের বোর্ড থেকে!


আর কতো? আমরা কেনো ঘুমিয়েই কাটাবো সময়। আসুন কিছু করি। নেতারা করুন ঘোষক বিতর্ক। আমরা করি শোষক বিতর্ক। কে আমাদের কতো বেশি শোষন করার কৃ্তিত্ব দেখালেন, সেটা জরিপ করতে শুরু করি।


এতে লাভ কী?

আমাদের কোনো লাভ হোক আর না হোক, আগামী প্রজন্মের অনেক লাভ হবে। তারা আমাদের মতো মানুষ চিনতে ভুল করবেনা। ধোকা খাবেনা।

কাজটি আমরা করতে পারি। মন্দ হবেনা আশাকরি ।

শনিবার, ২৬ মার্চ, ২০১১

দেশ তুমি কার ?

যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তেমন স্বাধীনতা কি চেয়েছিলাম? আর যে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম তেমন স্বাধীনতা কী আমরা পেয়েছি?

৪০ বছর পেরিয়ে গেছে আমরা স্বাধীনতা এনেছি। কিন্তু এখনো প্রশ্নটি সচেতন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে বেড়ায়, প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে। একটি পতাকা এবং স্বতন্ত্র ভূ-খণ্ডের মাঝেই যদি আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে যাই, অথবা তৃপ্তি , তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা।


শুধু আলাদা ভূ-খন্ড ও পতাকার নামই কি স্বাধীনতা?


স্বাধীনতা মানে তো অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা। আমরা কি সেটা পারছি?

স্বাধীনতা মানে তো নতজানু নীতি থেকে বেরিয়ে আসা। আমরা কী পেরেছি?
তাহলে এত বিদেশ তোষণ কেন?

স্বাধীনতা মানে তো স্বয়ং সম্পূর্ণতা। আমরা কী হতে পেরেছি? তাহলে বারবার কেন আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য নির্লজ্জের মত হাত বাড়াচ্ছি বিদেশিদের দিকে?


বিজয় মানে তো পরাজয় এর গ্লানি গা থেকে ঝেড়ে ফেলা। আমরা কি সেটা করতে পেরেছি? তবে কেনো সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কাছে অসহায় আত্ম সমর্পন!


বিজয় মানে তো বীরত্বের গৌরব গাঁথা। তাহলে বারবার কেনো আমরা কাপুরুষের মত বিদেশিদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও কটুকথা হজম করে যাচ্ছি!!


কে দেবে জবাব? কার কাছে চাইবো আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর?

আওয়ামীলীগের কাছে?
বিএনপি’র কাছে?

সামরিক সরকারের শাসনামল ছাড়া বাংলাদেশের পুরোটা সময়তো পালাক্রমে এই দু'টি দলই শাসন করলো। কী দিয়েছে তারা আমাদের? কী করেছে তারা আমাদের জন্য? বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে তাদের কোনো অবদান আছে কী? দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানানো ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আমাদের জন্য তারা আর কী করেছেন?


তারা এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করার প্লান-প্রোগ্রামে যে সময় ব্যয় করেন, সেই সময়টুকুই যদি দেশের জন্য দিতেন, নিঃসার্থ হয়ে, তাহলে বাংলাদেশকে কি অনেক উপরে উঠে যেত না? পরিবারতন্ত্রের খপ্পর থেকে আমরা কি কখনো মুক্তি পাবো না? পরিবারতন্ত্রের গ্যাড়াকল থেকে কবে বেরুবে আমাদের গণতন্ত্র?


দল-নিরপেক্ষ একজন সচেতন নাগরিক তো প্রশ্ন করতেই পারে বাংলাদেশ তুমি কার?

আওয়ামীলীগের?
বিএনপি’র?
অথবা আরেকটু সাহস করে বলতে পারে বাংলাদেশ তুমি কার?
খালেদা জিয়ার?
নাকি শেখ হাসিনার?

দুই

স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমরা ভুলে বসে আছি। ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে এই দেশটি স্বাধীন করে এ জন্য দিয়ে যায়নি যে, আমরা যা ইচ্ছা তাই করবো। যেমন খুশি, তেমন চলবো। তারা চেয়েছিলো তাদের বাংলাদেশের মানুষগুলো মাথা উচু করে বাঁচবে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবে। সর্বোপরি নিঃশর্তভাবে দেশকে ভালবাসবে। শুধুই বাংলাদেশকে। আমরা যদি সেটা করতে না পারি, তাহলে স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মাঝে ব্যবধান থাকলো কই?

২৬শে মার্চ এসেছে। প্রতি বছরই একবার করে আসে। আমাদের জানিয়ে দিতে যে, আমরা কতো বড় অকৃতজ্ঞ। আমরা সেটা গায়ে মাখি না। লজ্জা আমাদের থেকে কতো আলোক বর্ষ দূরে চলে গেছে-কে জানে! আমরা পুরুষরা লজ্জা পাইনা কারণ, লজ্জা নারীর ভূষণ! নারীরা পাইনা কারণ পুরুষের সমান অধিকারের যুগ!


আর এভাবেই নির্লজ্জতা, নিমকহারামী, অকৃতজ্ঞতা ও বেঈমানিকে নিত্য সঙ্গি করেই আমাদের অদ্ভুত জীবন চলা!!


আজব এক দেশে বাস করি আমরা। এক দেশে ছিলো এক রাজা... টাইপ দেশগুলোতেও মনে হয় এই অবস্থা নেই! এদেশে আমরা রাজাকারকেও রাষ্ট্রপতি বানাই! স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে পতাকা টানিয়ে দেই! মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ফিরেও তাকাই না। যদি তাকাই-ও, সেটা মরার পরে! জীবিতদের শরীরে দেশদ্রোহিতার গন্ধ খুঁজি। পেয়েও যাই!। তাকে ফাসির সুসংবাদ(!) পর্যন্ত শোনাতে দ্বিধা করি না। মেজর জলিলরা, কর্ণেল তাহেররা, মুক্তিযোদ্ধারা এভাবেই যুগে যুগে আমাদের দ্বারা পুরস্কৃত হয়ে থাকেন!!!


তিন

আমরা ছিলাম পাকিস্তান নামক একটি দেশের খাদ্য। ২৪টি বছর তারা আমাদের ঘাড়ে চেপে রয়েছে তারা। লেবু চিপে রস বের করার মতো বের করে নিয়েছে আমাদের শরীরের যত রক্ত। স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাসটুকু পর্যন্ত নিতে দেয়নি আমাদের! অনেকটা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটপট করছিলো তখন সাড়ে সাতকোটি বাঙালি। এই অবস্থায় রুখে দাঁড়ানো হয়ে পড়েছিলো অনিবার্য। রুখে দাঁড়ালো সোয়া সাতকোটি মানুষ।
(নিরব ও রাজাকারের আনুমানিক সংখ্যা বাদ দেয়া হলো)

২৬শে মার্চ ১৯৭১ থেকে নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮ মাস ২২ দিনে ৩০ লক্ষ জীবন এবং ২ লক্ষ সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেলাম সতন্ত্র একটি পতাকা, লাল-সবুজ। অথচ, যাদের জন্য আজ আমরা মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, তাঁরা কিন্তু ভোগছে শ্বাস কষ্টে! ফিরে তাকাবার সময় নেই আমাদের!


পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা পা হারিয়ে ঘরে বসে আছে আজ ৪০ বছর হলো। থাকুক বসে, আমাদের কী! আমরা আমাদের পায়ে সামান্য ব্যথা হলে ছুটে যাচ্ছি মাউন্ট এলিজাবেত কিংবা কিং ফাহাদে।!


বোমার বিকট শব্দে শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে মানুষটি বেঁচে আছে ৩৯ বছর ধরে, মরার মতো। আমাদের কী! আমরা তো আমাদের কানের চিকিৎসায় ছুটে যেতে পারছি আমেরিকায়?

আচ্ছা আমাদের হলোটা কী?

আবার ফিরে এসেছে মার্চ। কদর বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। ২৬ কে কেন্দ্রকরে মৌসুমী দেশ প্রেমিকদের চেতনা উতলে উঠবে।

কিছু ফুল দেয়া হবে
কিছু পদক বিতরণ হবে
কিছু আলোচনা সভা হবে
কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্টান হবে
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কিছু বিতর্ক হবে
এই তো!!

জীবিত থাকতে খোঁজ-খবর নেয়ার দরকার মনে না করলেও কিছু মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী বা এতিম ছেলের ধরে এনে তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে একটি তোষা শিরিণি'র প্যাকেট। যার কেতাবী নাম-মরণোত্তর।



আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করতাম,-


জীবিত থাকতে আমরা তোমাদের খোঁজ নিই নি! খুব যখন বাঁচতে চাইছিলে, আমরা এগিয়ে আসি নি! আর আজ,তুমি যখন নেই, আমরা তোমাকে মরণোত্তর পদক দিচ্ছি!

তুমি কি খুব খুশি হয়েছো?

আজ আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, প্রিয় মুক্তিযুদ্ধ! প্রিয় স্বাধীনতা! তোমরা কিছু মনে করোনা। আমরা ততোটা অকৃ্তজ্ঞ না যতটা ভাবছো! আর না হোক, প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর এবং ২৬শে মার্চ তোমাদের স্মরণ করবো। কথা দিলাম।


তাতে যদি সন্তুষ্ট হতে না পারো, অপেক্ষা করতে হবে। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। এদেশে একটি নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, যারা আওয়ামীলীগ-বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি মার্কা রাজনৈতিক বাণিজ্যের সাথে জড়িয়ে নেই। যারা রাজনীতি করেনা, রাজনীতির মারপ্যাঁচও বুঝেনা। শুধু বুঝে দেশকে ভালোবাসতে হবে। শুধুই দেশকে।


এদের সংখ্যা বাড়ছে। দিনদিন বাড়ছে। একদিন তার সেই বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যে দেশটির স্বপ্ন দেখে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছিলো আমার ভাই। তার আগ পর্যন্ত,প্রিয় স্বাধীনতা, আমাদের ক্ষমা করে দিও

রক্তচোষা এক মহান জাদুকর !


সুফিয়া খাতুন মারা গেছেন বারো বছর আগে, ১৯৯৮ সালে। সহায়-সম্ভলহীন এই মানুষটি মারা যাবার পর কাফন-দাফনের পয়সাও ছিলোনা পরিবারের কাছে। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে তাঁর দাফনের ব্যবস্থা করে। অথচ:এই সুফিয়া আন্তর্জাতিক  বিশ্বের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। একজন স্বচ্ছল-স্বাবলম্ভি মহিলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। আমি চট্রগ্রামের জোবরা গ্রামের শিকদারপাড়ার সেই সুফিয়ার কথাই বলছি, আজ থেকে ৩৬ বছর আগে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত এক শিক্ষক, মুহাম্মদ ইউনুস নামের এক ব্যক্তি যে মেয়েটিকে মাত্র ২০ টাকা ঋণ দিয়ে শুরু করেছিলেন সুদের রমরমা বিজনেস, ক্ষুদ্র ঋণের মহাজনী ব্যবসা।

সময় গড়িয়ে যায়। সুফিয়া সুফিয়াই থেকে যান। তাঁর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আর হয় না। অনাহারে-অর্ধাহারে এবং বিনা টিকিৎসায় একদিন মারা যান সুফিয়া। আর সুফিয়াদের মার্কেটিং করে অখ্যাত সেই শিক্ষক হয়ে যান বিখ্যাত।  অশান্তিতে ছটপট করতে করতে মারা যেতে থাকে সুফিয়ারা। বিখ্যাত সেই মহাজন পেয়ে যান শান্তির নোবেল!
সুফিয়াদের কথায় পরে আসছি। তার আগে কিছু খুচরো কথা।
আমাদের দেশে ‘ভাবমূর্তি’ নামের অতি স্পর্শকাতর একটি বস্তু আছে। এটি থাকে কচুপাতার উপরে। সবসময় টলমল করতে থাকে। কখন পড়ে যায় কখন পড়ে যায় অবস্থা! এক শ্রেণীর মানুষও আছেন এদেশে। যাদের কেতাবি নাম সুশীল শ্রেণী। তাদের সকল কর্মকাণ্ড এই কচুপাতায় থাকা বস্তুকে ঘিরেই পরিচালিত হয়। সকাল-সন্ধ্যা তারা মত্ত থাকেন ভাবমূর্তি বন্দনায়। কচুগাছটির গোড়ায় নিয়মিত পানি দিতে নসিহত করে বেড়ান অথচ নিজেরা ভুলেও এই কাজটি কখনো করেন না।
 ড.ইউনুসের পাপ বালেগ হয়ে যাবার পর তাকে অপসারণ করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে। বিধি অনুযায়ী ইউনুস ষাট বছর বয়স পর্যন্ত এই পদে থাকবার যোগ্যতা রাখেন। হযরতের বর্তমান বয়স একাত্তর। ব্যাপারটি তাকে জানানোও হয়েছিলো বারবার। বলা হয়েছিলো আপনি সম্মানী মানুষ। সম্মান নিয়ে সরে পড়–ন। তিনি সরেননি। লাখো গরিবের চোখের পানি ঝরেছে যার কারণে, অসংখ্য অসহায়ের বুকফাঁটা অভিশাপের মালা ঝুলে রয়েছে যার গলায়, সম্মান অবশ্য তার ভাগ্যে ঝুটার কথাও নয়।
সিদ্ধান্তটি মেনে নিলেন না ইউনুস। গেলেন উচ্চ আদালতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে  আদালতকে তিনি বললেন, আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। আমি আজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে চাই। ওরা থাকতে দিতে রাজি হচ্ছে না। বলে দেয়া হোক আমাকে যেনো থাকতে দেয়া হয়।
মহামান্য আদালত ফরিয়াদটি  তিনদিন ধরে শুনলেন। কাগজপত্র দেখলেন। সবকথা বিচার-বিশ্লেষণ করলেন। তারপর বললেন, ইউনুস সাহেব! কিছু মনে করবেন না। আপনাকে অব্যহতি দেয়ার আদেশটি সঠিকভাবেই দেয়া হয়েছে। আপনি অনেকদিন বে-আইনিভাবে পদে ছিলেন। আর না থাকাই ভালো। আইনের চোখে সবাই সমান।
এই যখন অবস্থা, তখন আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ করছি ইউনুস ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন সুশীল শ্রেণীর স্বঘোষিত ঠিকাদাররা। ইউনুসের মতো এতো বড়মাপের একজন বুজুর্গকে যে অপমান করা হয়েছে এবং এতেকরে দেশের ভাবমূর্তি যে একেবারেই শেষ হয়ে যাচ্ছে,  সে ব্যাপারে চিৎকার করে বলতে শুরু করেছেন তাঁরা। পশ্চিমপাড়ার বন্ধুদের নজর কাড়ার জন্য হোক আর  দেশি-বিদেশি মক্কেলদের নিমকহালালীর জন্যই হোক, ইউনুসের জন্য তাদের দরদ সাংঘাতিকভাবে উতলে উঠেছে! একচোখা এই বুদ্ধির ফেরিওয়ালাদের  চোখের সামনে একবারও ভেসে উঠছেনা ইউনুসের প্যাঁচে পড়ে পথে নামা এদেশের অসহায় মানুষের ফুটো হয়ে যাওয়া মুখগুলো।  তাদের চোখে পড়ছেনা ইউনুস সাহেবের অন্যায় আস্থাভাজন হতে না পারায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চাকরি খোয়ানো সাড়ে ৮ হাজার মানুষের বিধ্বস্ত চেহারাগুলো।  ইউনুস সাহেবের সম্মান আছে, গরিবের বুঝি সম্মান থাকতে নেই? হায়রে বুদ্ধিজীবি! মূর্খতাই তবে কেনো শ্রেয় হবে না?
ইউনুস সাহেবের বিদেশি বন্ধুরা তাকে নিয়ে পেরেশান। মরিয়াটিদের দৌড়-ঝাপ দেখে মনে হচ্ছে বর্তমানে কাজ তাদের একটাই, যে কোনো উপায়ে তাদের বন্ধুকে যথাস্থানে জিন্দা রাখা। আর এটা করতে গিয়ে সকল নিয়ম-নীতি লঙ্গন করে  কুটনৈতিক শিষ্টাচার বেমালুম ভুলে গিয়ে এমনভাবে কথা বলে চলেছেন তাঁরা, যেভাবে বলবার কোনো অধিকারই তাদের নেই। আমার দেশের তথাকথিত সুশীলরা একটিবারও বলতে পারছেন না গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান। ড.ইউনুসও একজন বাঙালি। সুতরাং এটি আমাদের ঘরোয়া বিষয়। এখানে আমরা আমাদের আইনে যা খুশি, তাই করবো। তোমরা কথা বলার কে?
দুই\
ড. ইউনুসকে অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না দেয়ায় মারাতœক গোস্বা করেছে আমেরিকা। খুব ঘনঘন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা টাইপ শব্দ কচলাচ্ছে তারা আজকাল। আমরা সাধারণ মানুষ ভেবে পাচ্ছিনা এখানে তাদের এতো পেরেশান হবার কারণ কী? তারা কেনো বুঝতে চাইবেনা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে যে কোনো সিদ্ধান্তই আমরা নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রেসক্রিপশনের কোনো দরকার নেই। হিলারি ক্লিনটন বা ক্লিনটন ফ্যামিলির সাথে ইউনুস সাহেবের সু-সম্পর্ক থাকতে পারে। ইউনুস সাহেব কখনো কোনো মুচলেকা-টুচলেকা দিয়ে থাকলে তিনি হয়তো তাদের কাছে ধরা থাকতে পারেন। কিন্তু দেশের ষোল কোটি মানুষের তো কোনো দায় নেই কারো কাছে।
আমার খুব মনে পড়ছে ৩৯ বছর আগের কথা। মার্চ মাস চলছে। আজ থেকে ৩৯ বছর আগে এমনি এক মার্চের ২৬ তারিখ আমরা শুরু করেছিলাম স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আমেরিকা সেদিনও আমাদের বিরোধীতা করেছিলো। জালিমের পক্ষেই থাকে তাদের অবস্থান। পশ্চিম পাকিস্তানি কুকুরগুলো যখন পাগল হয়ে গিয়েছিলো, পাখির মতো গুলিকরে মারছিলো আমার ভাইকে, তখনও আমেরিকা ছিলো তাদের পক্ষে। এমনকি আমাদের মারবার জন্য নৌ-বহর পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এরা স্বাধীনতার আগেও আমাদের মেনে নেয়নি, পরেও না। সদ্য-স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত আমার দেশটি নিয়ে সেদিন তারা কম নাক সিটকায়নি। হেনরি কিসিন্জাররা আমার দেশকে নিয়ে বিদ্রুপ করতো। বলতো, বটমলেস বাস্কেট, তলাবিহীন ঝুড়ি!
 সেই আমেরিকা আজ আমার দেশের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার নিয়ে শুধু নাকই গলাচ্ছে না, রীতিমতো মাথাটাই ঢুকিয়ে দিতে চাইছে!  একজন ইউনুসের জন্য  এতো মায়া কেনো তাদের? কারণটা কী? 
 নিজ দেশের হাজার হাজার মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়া একজন মানুষ পেয়ে যান শান্তিতে নোবেল! রাজনীতিবিদ না হয়েও দম্ভের সাথে ঘোষণা করতে পারেন, দুই নেত্রীকে একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা দরকার। ওয়ান-ইলেভেনের সময় যখন দেশে সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ, তখন কোন খুটির জোরে ইউনুস সাহেব নাগরিক শক্তি নামের রাজনৈতিক দল গঠনের পায়তারা করতে পারলেন, মাইনাস টু থিওরি বাজারজাত করণের ঠিকাদারী... এই ধরণের বিষয়গুলোকে সামনে রাখলে এবং নির্মোহ পর্যালোচনা করতে পারলে কারণটা স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা। আমেরিকার বড় ইচ্ছে ইউনুস সাহেবের নামটি পরিবর্তন করে নতুন একটি নাম রাখা। সেই নামটি হবে হামিদ কারজাঈ! এটা কি আমার দেশের তথাকথিত সেই সুশীল শ্রেণী বুঝতে পারছেন? না পারলে তাদেরকে আর লেখাপড়া করতে বলেছিলো কে?
 অনেকের কাছেই একটি ব্যাপার স্পষ্ট নয়। শান্তিতে নোবেল পাবার জন্য ড. ইউনুসের ব্যাকগ্রাউন্ডটা কী ছিলো? সুদের কারবারি হলেও তিনি একজন অর্থনীতিবিদ। তাকে অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া হলেও না হয় একটা কথা ছিলো। দেয়া হলো শান্তিতে! ঘটনা কী?
স¤প্রতি আমি একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি। সে অলোকে একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছি। সেটা এরকম,
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ মেহনতে ৮ টি এনজিও’র মাধ্যমে পার্বত্য চট্রগ্রামের চারটি জেলায় মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বি মানুষকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করার কর্মকাণ্ড বেশ জোরেসুরেই চলছে। শতশত কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। সস্থির কথা হচ্ছে বিষয়টি আমাদের সরকারের নজরেও এসেছে। উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত চলছে। আমাদের স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুস সুবহান জানিয়েছেন,পার্বত্য অঞ্চলের এনজিওগুলোর কাজ সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রতারকদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
আর সম্ভবত পার্বত্য চট্রগ্রামের চার জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজারের মানুষকে ছলে বলে কলে কৌশলে ধর্মান্তরিত করা এবং মওকা বুঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গোষ্টীকে উসকে দিয়ে দেশের অখণ্ডতার পাঁজরে আঘাত বসানো এবং অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে, এই কাজটির গোপন কোনো কন্টাক্ট ইউনুস সাহেবকে দেয়া হয়ে থাকলে শান্তিতে নোবেলের সার্থকতা প্রশ্নাতীত। কাজটি ঠান্ডা মাথায় এবং শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে!
তিন \
প্রসঙ্গক্রমে আবার চলে আসে সুশীল শ্রেণীর কথা। ড. ইউনুসের জন্য তাদের অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে! হতেই পারে। নুন, দেশি হোক বা বিদেশি, খেলে তো গুণ গাইতেই হয়। ড. ইউনুসের মতো একজন ধোয়া তুলসির পাতাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করার কারণে দেশের ভাবমূর্তি কত হাত মাটির নিচে চলে গেছে, সেটা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত! দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার এই মিছিলে শরীক হয়েছেন দেশনেত্রীও, সদলবলে। ইউনুস সাহেবের পক্ষে বিবৃতির ফুলঝুরি বর্ষিত হচ্ছে বেগম জিয়ার মুখ থেকে। এই ইস্যুতে আবার হরতাল-টরতাল ডেকে বসেন কি না-কে জানে!
বিএনপি দেশের প্রধান বিরোধীদল। বিরোধীদলের মানে কি সরকার যা করবে, সব কাজেরই বিরোধীতা করা? ড. ইউনুসের ঋণ বাণিজ্যের পাল্লায় পড়ে সর্বশ্রান্ত হওয়া এদেশের হাজার হাজার মানুষের দুর্গতি বেগম জিয়াকে বিচলিত করলো না!  ইউনুস সাহেবের কল্যাণে বাড়িঘর বিক্রি করে খোলা আকাশের নিচে বাস করতে থাকা এদেশের অসংখ্য মানুষের দুর্দশা নেত্রীকে কষ্ট দিলো না! তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ইউনুস সাহেবের ভাবমূর্তি নিয়ে!  হায়রে বাংলাদেশের রাজনীতি!!
 বেগম খালেদা জিয়া এবং ড. ইউনুসের জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামা মুরব্বীরা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের আমলনামার কথা ভুলে গেছেন। সমস্যা নেই। আমরা ছোট’রা আছি কী জন্যে! ইউনুস সাহেবের সুকীর্তি’র অতি সামান্য কিছু চিত্র সামনে নিয়ে আসলে তাদের মনে পড়বে ইউনুস কতো মহৎ!
ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা (নাকি প্রভোক্তা), দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর ঘোষণা দেয়া ড. মুহাম্মদ ইউনুস নিজেই হয়ে যান দারিদ্রের বহুরূপী এক জাদুকর! এই ভদ্রলোকের সুদভিত্তিক আমলনামা এতই বড় ও বিস্তৃত যে, জেনে ও লিখে শেষ করবার উপায় নেই। বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম, বাংলানিউজ ডটকমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট ঘাটাঘাটি করে পাওয়া গেলো ইউনুস সাহেবের মহাজনী শোষণের বিভিন্ন তথ্য।
 ১৯৯৫ সালের মার্চ মাস। যশোর সদর উপজেলার মথুরাপুরের অসহায় মহিলা সাহেবা বিবি। অভাবের তাড়নায় ৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। কিস্তিও পরিশোধ করে যাচ্ছিলেন যথারীতি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাড়ি-পাতিল বিক্রি করে সুদের কিস্তি পরিশোধ করে যেতে হয় তাঁকে। কয়েকটি কিস্তি অপরিশোধিত থেকে যায়। এরমধ্যে আবার সাহেবার ভ্যানচালক স্বামীও অসুস্থ হয়ে পড়ে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে দু’বেলা পেটের ভাতই ঝুটেনা অবস্থা। বাকি পড়ে যায় কয়েকটি কিস্তি।
ইউনুস সাহেবের বাহিনী এসে আক্রমণ করলো সাহেবাকে। ক’টা দিন সময় চাইলো তাঁরা। বললো, একটু দয়া করেন আমাদের। একটু সুস্থ হয়ে নিই। তারপর দিনরাত খেটে সব পাওনা মিটিয়ে দেবো। কাজ হলো না। গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রপ্রধান নূরজাহানের নেতৃত্বে ইউনুস বাহিনী ছিনিয়ে নিয়ে গেলো সাহেবার ছাগলটি। নিয়ে গেলো তাঁর স্বামীর, তাদের বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন ভ্যান গাড়িটিও।
চার\
পাঠকের মনে থাকবার কথা ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন আমেরিকার ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন। এসেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে। হিলারির জন্য নববধুর সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিলো ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার মশিহাটির ঋষিপাড়াকে। ৫ এপ্রিল ঋষিপাড়ায় হিলারির পদধূলি পড়ার পর ম্যাডামের সম্মানে এলাকার নামটাই পাল্টে ফেলা হয়। ঋষিপাড়ার নতুন নাম হয়-হিলারি পল্লি। সেদিন গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের এনে মুরিদ করানো হয় হিলারির কাছে। জামদানি শাড়ি পরে, মুড়িভাজা খেয়ে খেয়ে হিলারি নতুন মুরিদদের সবকও দেন। সবকটি একেবারে মূখস্ত করিয়ে দিয়ে যান। উচ্চারণ করান, যৌতুক আর দেবো না, বাল্য বিয়ে মানবো না, বদ্ধ ঘরে থাকবো না...। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অইদিন মশিহাটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে সাথী ও মুক্তি নামের যে দু’টি শিশু মেয়ে ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলো হিলারিকে, সেই মেয়ে দু’টিকেও বলি হতে হয়েছিলো বাল্য বিবাহের। ১৯৯৯ সালে ১২ বছরের সাথীর বিয়ে হয় হিরন্ময় নামের যুবকের সাথে। ১১ বছরের মুক্তির বিয়ে হয় মুক্তা নামের এক জুতার মিস্ত্রির সাথে। তাদের বিয়েতেও টেলিভিশন, সাইকেল, ঘড়ি ইত্যাদি দিতে হয় যৌতুক হিসেবে!
আরো দু:খজনক ঘটনা হলো, মুক্তি নামের সেই মেয়েটির বাবাও মুক্তি পাননি ইউনুসীয় থাবা থেকে। ইউনুস সাহেবের মহান একটি গুণ হলো, সুদের কিস্তির ব্যাপারে কারো সাথেই আপোস করেন না তিনি। ছাড়েননি মুক্তির বাবা মুকিন্দকেও। সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে যেয়ে বেচারা মুকিন্দকে ভিটেমাটি বিক্রি করে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিলো।
চাইলে এমন উদাহরণ দেয়া যাবে ভুরিভুরি। মাইক্রো ক্রেডিটের এই মহান জাদুকরের ঋণের পাতানো জালে ফেঁসে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বশ্রান্ত হতে হয় যশোরের সেই মশিহাটির লাবনী, শান্তি, শ্রাবণ, ভানুদাস, মিনারাণী, গীতা, সন্তুসহ নাম না জানা আরো কতো মানুষকে! মাত্র সাত হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মারা গিয়েছিলো দরিদ্র গৃহবধু পারুল। ইউনুসের গুণধর সৈনিকেরা লাশ আটকে দিয়েছিলো মেয়েটির। আগে ঋণের টাকা পরিশোধ, তারপর লাশ দাহ। শেষে পারুলের স্বামী কার্ত্তিক সুদে-আসলে টাকা পরিশোধের মুচলেকা দিয়ে লাশ সৎকারের সুযোগ পায়। মমতা নামের মেয়েটিকে কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বিক্রি করতে হয় ঘরের চালের টিন। মায়ারাণীকে বিক্রি করতে হয় ছাগল, গরু এমনকি বিয়ের আংটিটি পর্যন্ত।
 মোটকথা, অভাবের তাড়নায় পেটের জ্বালায় ইউনুস সাহেবের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের পর থেকে ঋণ গ্রহীতাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর আরাম হারাম হয়ে যেতো। সকল অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে হতো নিরবে। প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারতোনা কেউ। কারণ, কারো ঘাড়েই দ’ুটি মাথা ছিলো না।
 ঝিনাইদহের বিপ্ল¬বী কমিউনিস্ট নেতা মীর ইলিয়াছ হোসেন দীলিপ। গ্রামীণ ব্যাংকের কুকীর্তি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন ১৯৯৫ সালে। বইটির নাম ছিলো-‘গ্রামীণ ব্যাংক, মহাজনী শোষণের অভিনব হাতিয়ার’। দেখাগেলো কিছুদিনের মধ্যেই লাশ হয়ে গেছেন তিনি। ২০০০ সালের ১৫ই জানুয়ারি গুলি করে মেরে ফেলা হলো দীলিপকে!
পাঁচ \
৩৬% সুদের রমরমা ব্যবসা এদেশে কেবল ড. ইউনুসই করতে পেরেছেন। তারপরও তিনি মাইক্রো ক্রেডিটের জনক!  দেশের গরিবের ভাগ্য নিয়ে বিদেশের সাথে ভালোই ব্যবসা করতে পেরেছেন তিনি। আমাদের মাথা বিক্রি করে দাতাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগ করেছেন নিজের আত্মীয়-স্বজনের ফার্মে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানে। কিছু অবশ্য গরিবও পেয়েছে। তবে সাহায্য হিসেবে নয়, চড়া হারে সুদভিত্তিক ঋণ হিসেবে। সময়মত যে ঋণের কিস্তি পরিশোধে অপারগ হলে খুলে নেয়া হয়েছে চালের টিন পর্যন্ত।
গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিলের অবস্থা খুবই শক্তিশালী। আবার বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান হাওয়ার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোনের ৩৫% মালিকানাও এই গ্রামীণ ব্যাংকের। তারপরও গরিবের রক্তচোষার সিরিঞ্জটি গুটিয়ে নেননি ড. ইউসুস। ‘রক্ত চাই আরো চাই’ নীতিই ছিলো তার সবচে’ প্রিয় নীতি। দারিদ্রের এই জাদুকর সময় সময় আমাদের মাথা বেঁচে বাইরে থেকে মোট কতো হাজার কোটি টাকা নিয়ে এসেছিলেন, সেই প্রশ্নটি আমাদের কোনো সরকার তাকে করেছিলো কি না, কে জানে!
ছয়\
আমাদের দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানোর মুখরোচক স্লোগান দিয়ে ইউনুস সাহেব বাইরে থেকে কতো বিলিয়ন ডলার নিয়ে এসেছেন, সেটার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের সরকারগুলোর কাছে নেই সম্ভবত! থাকলে তো ইউনুস সাহেবের তহবিল কারসাজির কাহিনী নরওয়ে থেকে আমাদের জানতে হতো না। স¤প্রতি নরওয়ে থেকে ইউনুস সাহেবের তহবিল কেলেংকারির খবর ফাঁস হবার পর একে একে থলের বিড়ালগুলোও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ইউনুসীয় কুকীর্তির আনবিক বোমাটি ফাটান ডেনমার্কের সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হাইনেমান। কট ইন মাইক্রো ডেট বা ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে শিরোণামে তৈরি প্রামাণ্য চিত্রটি বিশ্বের সামনে প্রকাশ করে দেয় নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনকেআর। ৩০ সভেম্বর ২০১০ ডকুমেন্টারি প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবার পর ইউনুস সাহেবের চেহারা থেকে ভালো মানুষের কৃত্রিম পর্দাটি সরে যায়। এদেশের দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করবার নাম করে নোরাডের কাছ থেকে সাহায্য হিসেবে আনা ৭শ কোটি ডলার তহবিল স্থানান্তরের তথ্য বেরিয়ে আসে। দেখা যায়, ইউনুস সাহেব টাকাগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের ফান্ড থেকে সরিয়ে ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামের উনার আরেকটি প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে রাখেন। ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যাবার পর এ ব্যপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কর বাঁচানো (ফাঁকি)’র জন্য তিনি এই সুকর্মটি করেছেন। রাষ্ট্রের কর ফাঁকি দেয়ার কাজ এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। ইউনুস সাহেবের ভাগ্য ভালো, এনবিআর তাকে অপমান করে টেনে-হেচরে আদালতে নিয়ে যায়নি। হয়তো পকেটে একটি নোবেল ছিলো বলে!
সাত \
লেখাটি শুরু করেছিলাম সুফিয়া খাতুনের গল্প দিয়ে। তাঁকে দিয়েই শেষ করি।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামের শিকদারপাড়ার দরিদ্র মহিলা সুফিয়া খাতুন। অভাবের সংসার তাঁর। দু’বেলা খাবার ঝুটেনা ঠিকমত। সময়টা ১৯৭৪ সাল। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অখ্যাত এক শিক্ষক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। কীভাবে কীভাবে জানি তার সাথে পরিচিত হয়ে যায় সুফিয়া। টাকা ধার চায় তার কাছে। ইউনুস তাঁকে ২০ টাকা ধার দেন। বলেদেন, সময়মত শোধ করতে পারলে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হবে। আরো বেশি পাবার আশায় সময়ের আগেই ঋণ পরিশোধ করে দেয় সুফিয়া। এরপর তাঁকে দেয়া হয় ৫০০ টাকা।  একসাথে ৫শ টাকা হাতে পেয়ে সুফিয়া তো আনন্দে আতœহারা!  খুশির চোটে ব্যাপারটি চাউর করে দেয় সারা গ্রামে। আর ঠিক এমনটিই চাচ্ছিলেন গরিবের বন্ধু ইউনুস। দলে দলে অভাবি মহিলারা এসে ভিড় জমাতে থাকে ইউনুস সাহেবের পাশে। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট সুদের কারবার। 
 যে সুফিয়াকে ২০ টাকা ঋণ দিয়ে শুরু হয়েছিলো ড. ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা, সেই সুফিয়াদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আর হয়নি। ১৯৯৮ সালে পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় সুফিয়া। ইউনুস সাহেব কাছেও যাননি! গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে গরিব এই মহিলাটির কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করে। আজও সুফিয়ার ভাঙ্গা বাড়িতে তাঁর অসুস্থ দুই মেয়ে হালিমা (৫৫) এবং নূর নাহার (৫০) দিন কাটায় অনাহারে-অর্ধাহারে। পয়সার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা সুফিয়ার নাতনির। অথচ: এই সুফিয়াদেরকে কুড়ে ঘর থেকে বের করে এনে কীভাবে প্রাসাদের রাণী বানিয়ে দিয়েছেন, সেটার ৬ নম্বরী ডকুমেন্ট তৈরি করে বিশ্বব্যাপী সেটাকে ফলাও করে প্রকাশ করে ইউনুস সাহেব বাগিয়ে নেন শান্তিতে নোবেল ! সুফিয়ার পাশের বাড়ির মালিক দুবাই প্রবাসী একলোকের  দু’তলা বাড়িকে ইউনুস সাহেব প্রচার করতে থাকেন সুফিয়ার বাড়ি বলে! যে বাড়ি তিনি বানিয়ে দিয়েছেন!! জোচ্চরি আর কাকে বলে?
আট\
ইউনুস নামা, আগেই বলেছি, লিখে শেষ করা যাবে না। আজও কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে খুঁজলে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যারা ঘরহীন। প্ল¬াটফরমেই রাত কাটায় তারা। জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে এক সময় একটি ঘর ছিলো তাদের। ইউনুস সাহেবের ঋণ বাণিজ্যের জালে ফেঁসে গিয়ে কিস্তির প্যাঁচে পড়ে তাদের এই অবস্থা।  আজও ইউনুস সাহেবের গোদামে মরচে ধরা সেই টিনগুলো খুঁজলে পাওয়া যাবে যেগুলো তিনি খুলে এনেছিলেন গরিবের চাল থেকে। এদেশের হাজার হাজার মানুষকে স্থায়ীভাবে পথে নামানোর মহানায়ক গরিবের বন্ধু(?) ইউনুস দেরিতে হলেও ধরা খেয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুুব একটা  বাড়িয়ে বলেননি, “গরিবের রক্তচুষে খেলে ধরা তো খেতেই হয়।” এবারে বোধ’য় দালালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটা আমরা দেখতেই পারি ।