বাংলাদেশের বহুধাবিভক্ত উলামায়ে কেরামের ছোট্ট একটি অংশের সিংহাসনের মালিক, একলা চলো নীতি’র ধারক মুফতি ফজলুল হক আমিনী’র ডাকে ৪ঠা এপ্রিল সারাদেশে পালিত হলো সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। কীভাবে কী হলো, অথবা যেভাবেই যা হোক, হরতাল সফল হয়েছে। সরকারকে এই ম্যাসেজটি পাঠানো গেছে, পানক সাপের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর খাহেশ থাকা ভালো না! সরকারের থিংক ট্যাংক বোধকরি ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, আলেম সমাজের ছোট্ট একটি অংশের ডাকা হরতালের চেহারা যদি এমন হয়, সারাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে, রাস্তাঘাট হয়ে যায় যান শূন্য, তাহলে আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি হরতাল আহবান করলে কী হবে অবস্থা! তখন রাস্তায় একটি পিঁপড়াও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না- বলা মুশকিল!
মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে সরকারকে একটি সু-সংবাদ দিতে চাই আমি। বলতে চাই, আমার কথায় খামাখা ভয় পেয়ে টেনশান করে প্রেসার হাই করার দরকার নেই। এদেশের আলেম-উলামা বিচ্ছিন্ন থেকে থেকে প্রয়োজনে শহীদ হয়ে যাবেন তবুও ঐক্যবদ্ধ হবেন না। সব ভুলে একটি মাত্র ব্যানারের পেছনে তাঁরা কোনোদিনই জড়ো হবেন না। এই যে আমি ‘তাঁরা’ সর্বনামটিতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করলাম, সম্মানজনক কাউকে উদ্দেশ্য করলে ‘তাঁরা’তে চন্দ্রবিন্দু দিতে হয় বলে, আমাদের উলামা হযরাতগণের মধ্যে এমন কাউকে এবং অনেককে আমরা পরিচয় করিয়ে দিতে পারি, যারা পরস্পরের জন্য এই সামান্য চন্দ্রবিন্দুটুকু পর্যন্ত ব্যবহার করার মতো উদার হতে পারেন না! সুতরাং সরকার! নো টেনশান! নিশ্চিত থাকতে পারেন।
দুই\
এবার হরতালের কাহিনী বলি।
বলা নেই, কওয়া নেই, নিজস্ব ব্যানারে হুট করে একটি হরতাল ডেকে বসলেন মুফতি আমিনী! যদিও আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সার্বজনীন ইস্যু, নারী নীতি, ফতওয়া বিরোধী রায় বাতিল ও শিক্ষানীতি’র ইসলাম বিরোধী ধারা বাতিলের দাবিতে ছিলো এই হরতাল। কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে কথা বললে বা আন্দোলন করলে তো লাভ হবে না। আমিনী সাহেবের সিনিয়ার আলেমরা অনুরোধ জানালেন। হরতালটি স্থগিত করেন। আলাদা করে কর্মসূচি দিয়ে পরিবেশ ঘোলাটে করা ঠিক না। যা করার, ঐক্যবদ্ধভাবেই করা দরকার। আমিনী সাহেব সিদ্ধান্তে অনড় ! হরতাল হবেই। হাল ছেড়ে দিলেন বাকিরা। একজন না মানলে কী আর করা!
আমরা, সাধারণ মুসলমান পড়লাম বিভ্রান্তিতে! আজ দেখি, অমুক আলেম পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলছেন, এই হরতালে আমাদের সমর্থন নেই। আবার হরতালের পক্ষে আলেম-উলামাদের সমর্থনের চার রঙা বিজ্ঞাপনে তাঁদের নামও শোভা পায়! আমরা বুঝতে পারিনা কোনটি সত্য আর কোনটি তথ্য বিভ্রাট! ফলে হরতালকে ঘিরে ক্রমেই জমাট বাধতে থাকে বিভ্রান্তির বিব্রতকর ধোঁয়া।
এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ উলামায়ে কেরামকে মন থেকে ভালোবাসে। তাঁরা কোনো অবস্থাতেই চায়না আলেমদের সম্মান ভূলন্ঠিত হোক। হতাশ হয়ে পড়লো এরা। হরতাল ডেকেছেন মুফতি আমিনী। সারা দেশে আমিনী সাহেবের ক’ডজন কর্মী আছে, আঙুলে গুনেই বলে দেয়া যাবে। তাহলে হরতাল সফল করতে মাঠে নামবে কারা? আবার হরতাল ব্যর্থ হলে লোকে বলবে, মোল্লাদের হরতাল ব্যর্থ হয়েছে! কেউ মানেনি! ফলে আলেম-উলামার আগামী আন্দোলন হয়ে পড়বে গুরুত্বহীন। উপযোগ কমে যাবে আন্দোলনের। উভয় সংকট বলে যে একটা সমস্যা আছে, আলেমরা ভোগতে শুরু করলেন সেই সমস্যায়। আর সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কোথাকার পানি কোন দিকে গড়ায়, দেখবার জন্যে।
হরতাল ৪ এপ্রিল সোমবার। হরতালের আগের দিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হলো যশোরের ছেলে হুসাইন। ১৯ বছরের এই মাদরাসা ছাত্র ভাইটি আমার অংশ নিয়েছিলো হরতালের প্রচার মিছিলে। হুসাইনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নি:¯প্রাণ হরতাল সাফল্যের সুবাস পেতে আরম্ভ করলো। মুখ রক্ষা পেলো মুফতি আমিনীর। ইজ্জত রক্ষা হলো উলামায়ে কেরামের। আর এই হরতাল প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয়া অনেকগুলো প্রশ্ন আগামীর জন্য থেকে গেলো অমীমাংসিত আকারেই।
তিন\
এবারে কিছু কঠিন কথা বলতে যাচ্ছি আমি। অনেকেই নাখোশ হবেন জানি। তিরোস্কারের তীর ছুড়ে দেবেন আমার দিকে। সমস্যা নেই। বুক পেতে নেবো । লোকচুরি খেলাকরে অভ্যস্ত কেউ কেউ আবার তাকাবেন ৯০ ডিগ্রি বাঁবা চোখে। সমস্যা নেই। গায়ে মাখবোনা কিছু। কঠিন সত্য বলবার জন্য কিছু মানুষের চামড়াকে করে ফেলতে হয় গন্ডারের চামড়া। গন্ডার হতে আমার আপত্তি নেই। সিংহ শাবকদের ভেড়ার পাল থেকে বের করে নিয়ে আসতে, জাগিয়ে তুলতে, শুধু গন্ডার কেনো, মহা গন্ডার হতেও আপত্তি নেই আমার।
হরতাল ৪ এপ্রিল। ৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭ টায় সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। আড্ডার বিষয়: যশোরে মাদরাসা ছাত্র হত্যা। তখন এক সাংবাদিক বন্ধু আফসোস করে বললো, আমরা অবাক হচ্ছি রশীদ ভাই! এখানে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছি আমরা। কিন্তু আজ তো আমাদের এভাবে রিলাক্সড হয়ে বসে থাকার কথা ছিলো না! বিনা অপরাধে একটি ছাত্রকে গুলি করে মেরে ফেললো পুলিশ। কওমী মাদরাসার ছাত্রকে। সারা দেশে কয়েক লক্ষ কওমী ছাত্র আছে না! ওরা কোথায়? এখন তো সারা দেশ বিক্ষোভে দিশেহারা হয়ে যাবার কথা ছিলো। আমাদের হিমশিম খাবার কথা ছিলো সংবাদ কভার করতে করতে। ব্যাপার কী? কিছুই তো বুঝলাম না! আমিনী সাহেব কেমন আন্দোলন করছেন!
মনটা খারাপ করে বেরিয়ে এলাম আমি। ইসলামী ভাবধারার সাথে সম্পর্কহীন একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক, ধর্মীয় পরিচয়ে যে আবার মুসলমানও না, সেই বন্ধুটির মাঝে আমি যে মানবিক অনুভূতির জাগরণ লক্ষ করলাম, তার ছিটেফোটাও দেখা গেলো না আলেম-উলামাদের মাঝে। ভীষণ রকম খারাপ হয়ে গেলো মনটা। প্রায় নির্ঘুম একটি রাত পার করলাম।
হরতালের দিন, সারাদিন ঘুরে বেড়াতে হয়েছে আমাকে। পেশাগত কারণেই। রাস্তায় বেরিয়ে বিস্মিত হলাম আমি! রাজপথ মাদরাসা ছাত্রদের দখলে। ঘুরে ঘুরে, সিলেট শহরের অলি-গলিতেও দেখলাম একই দৃশ্য। এদের বেশিরভাগই মুফতি আমিনীর সমর্থক না। এদের অনেকেই রাজনীতি থেকেই নিরাপদ দূরে থাকতে পছন্দ করে। তবুও তারা মাঠে। কারণ কী?
মুহুর্তেই বিষয়টি ক্লিয়ার হয়ে গেলো আমার কাছে। মুরব্বীরা হুসাইনের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেও ছাত্ররা পারেনি। ভ্রাতৃত্বের টানে বেরিয়ে এসেছে তারা। স্বাভাবিক কারণেই মনটা ভরে গেলো কানায় কানায়। চোখ দু’টো ভিজে উঠলো। এক ভাইকে মেরে ফেলেছে, অন্য ভাই ঘরে বসে থাকতে পারে না। থাকেও নি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, বাংলাদেশের হাজার হাজার কওমী মাদরাসার এদিনের চেহারা ছিলো ভিন্ন। ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে এসেছে ছাত্ররা। বাধ ভাঙা জোয়ারের মতো। ছাত্রদের এই আবেগের পথে মাদরাসা কর্তৃপক্ষও, যাদের অধিকাংশই হরতালের সাথে ছিলেন না, বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বেরিয়ে আসতে দিয়েছেন। সময়ের তাক্বাজাকে চমৎতার দক্ষতায় বিশ্লেষন করতে পারায় উস্তাদদের প্রতি আমাদের বিনম্র সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা।
হরতাল পর্যবেক্ষণ করতে যেয়ে প্রতিটি ছাত্রের চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলতে দেখেছি আমি। তাদের বেদনামলীন চেহারার দিকে তাকিয়েছি। চেষ্টা করেছি তাদের মনের ভাষা পড়তে। তাদের অনুচ্চারিত বিক্ষোব্ধ হতাশার কথা জানতে। যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি আমি, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। তাদের ভেতরের মানুষগুলো চিৎকার করে বলছে, আমার ভাইকে মেরেছিস! মার, আমাদেরকেও মার। কতো রক্ত চাই তোদের? নে। আমরা বুক পেতে দিতে এসেছি। আমার ভাই যে অপরাধ করেছিলো, আমরাও সে অপরাধ করছি। জেনে-বুঝেই করছি। মার আমাদের। কর গুলি। আর না হলে জবাব দে, আমার ভাইকে মারলি কেনো??
পুলিশ জবাব দিতে পারেনি। জবাব যে তাদের নিজেদেরও জানা নেই। সরকারও নিরব! জবাব নেই সরকারের কাছেও। জবাব দিলো গরিব রিক্সাচালক, তাঁর রিক্সাটি বন্ধ রেখে। জবাব দিলো গরিব ভ্যান চালক, তার ভ্যানটি বন্ধ রেখে। জবাব দিলো গলির মোড়ের পান দোকানী, তাঁর দোকানটি বন্ধ রেখে। সাধারণ মানুষ জবাব দিলো হরতাল সমর্থন করে। আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সাধারণ মানুষ হরতালের পক্ষে থেকেছে কুরআনের সম্মানে। আর মাদরাসা ছাত্ররা সারাদিন রোদে পুড়ে না খেয়ে রাজপথে অবস্থান করেছে তাদের ভাই হুসাইনের জন্য। আর এই ফাঁকে সফল হয়ে গেলো আমিনী সাহেবের হরতাল। হিরো হয়ে গেলেন মুফতি আমিনী। আর যা হোক, যেভাবেই হোক, রক্ষা পেয়ে গেলো উলামায়ে কেরামের ভাবমূর্তি।
চার\
চার তারিখের হরতাল সর্বাত্বক সফল হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে স্বস্থি পেয়েছি আমি। আলেম সমাজ বেঁছে গেছেন বেইজ্জতি থেকে। কিন্তু এভাবে তো আর চলে না। আন্দোলন করতে হলে তো সু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে লাগবে। আন্-ডিসিপ্লেন্ড্ কাজ আর উদ্দেশ্যহীন ছুটন্ত ঘোড়ার মাঝে খুব কিছু ব্যবধান নেই তো । দায়িত্বহীনতা আর কান্ডজ্ঞানহীনতার মাঝে ফারাকও নেই । আমাদের নেতৃবৃন্দের লিডারশিপ কোয়ালিটি আরো ডেভেলপ করার দরকার আছে কিনা, ভেবে দেখা দরকার। প্রতিটি কর্মীকে নিজের সন্তান ভাবতে হবে। তবেই না সেটা ইসলামী আন্দোলন।
কেনো বলছি এ কথা!
যাদের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন দিলো হুসাইন, খুব খারাপ লেগেছে আমার, যখন জেনেছি, সেই মহান নেতাদের একজন কেউ ছেলেটির যানাজায় পর্যন্ত গিয়ে শরীক হবার সময় পাননি!। কেনো? একটি জীবনের মূল্য কি এতই কম? কেনো যাননি কেউ? পরদিন হরতাল, তাই ব্যস্ত ছিলেন। আরে ! যে ছেলেটির জীবন উৎসর্গিত না হলে মাঠে মারা যেতো হরতাল, শুকরিয়া আদায় করার জন্য হলেও তো তার যানাজায় হাজির হওয়া উচিৎ ছিলো। মুফতি আমিনী সাহেবের কাছে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারলে ভালো হতো। এই ছেলেটির বাবার নাম যদি হতো মুফতি ফজলুল হক আমিনী, তাহলে কি কোনো ব্যস্ততা আটকে রাখতে পারতো তাঁকে! কী বলেন মুফতি ওয়াক্কাস সাহেব? আপনাকেও বলছি।
হরতাল পালিত হলো ৪ঠা এপ্রিল। ৬ এপ্রিল দেশের শীর্ষ আলেম, আলেম সমাজের আস্থার প্রতীক, আল্লামা আহমদ শফী’কে আমীর করে গঠিত হলো সর্বদলীয় ইসলামী ঐক্য পরিষদ। দলমত নির্বিশেষে দেশের সবগুলো ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করলেন। উপস্থিত হলেন মুফতি আমিনীও। সভা’র শুরুতেই ৪ তারিখের হরতালের ব্যপারে নিজের অবস্থান ব্যখ্যা করলেন আহমদ শফী। বললেন, হরতালের সমর্থনে আমার কোনো বিবৃতি ছিলো না। আমার নামে পত্রিকায় বিবৃতি গেছে অথচ আমার সাথে কোনো যোগাযোগই করা হয়নি! আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখার পূর্ণ সুযোগ থাকা সত্তেও কপট রাগ দেখিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করলেন আমিনী সাহেব। এ কেমন আচরণ!
এরপর একে একে বেরিয়ে আসতে লগলো এমন আরো অনেক কিছু। দেখাগেলো, যে সব উলামা-মাশায়েখের নাম ব্যবহার করে পত্রিকায় বিবৃতি পাঠানো হয়েছিলো বিজ্ঞাপন আকারে, তাদের অধিকাংশই জানেন না ! আমিনী সাহেব আলেম-উলামাকে ইমোশনাল ব্লাকমেল করেছেন।
আমি ছোট মানুষ। হাত বাড়ালেই আমিনী সাহেবের মতো বড় নেতাকে নাগাল পাবো না। কেউ কি তাঁকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, নিজের ইমেজের প্রতি তাঁর এতই যদি আস্থাহীনতা, বাস্তব উপলব্দি যদি এতই প্রখর হয়ে থাকে, তিনি যদি বুঝতেই পারেন, আমার একা’র আযানে মুসল্লি পাওয়া যাবেনা, তাহলে তিনি একা থাকেন কেনো?
সরাসরি জিজ্ঞেস করবেন, আলেম-উলামা তো আপনাকে প্রাপ্য মর্যাদাসমেত সাথে নিয়েই কাজ করতে চান। আপনি সবসময় ডিগবাজি দিয়ে সরে যান কেনো? নেতা তো আপনি আছেনই। একক নেতৃত্ব চান? আর এজন্য একলা চলো নীতি? স্বীকার করছি আপনি বড় আলেম। কিন্তু যদি ভাবেন আপনিই বাংলাদেশের একমাত্র আলেম বা সবচে’ বড় আলেম, আপনার উপরে আর কেউ নেই বা থাকতে নেই, তাহলে তো সেটা হবে বালখিল্যসুলভ ভাবনা।
পাঁচ\
আন্দোলনের ডাক দেবেন। তা মুফতি আমিনী হোন আর অন্য যে-ই, ছেলেরা রাস্তায় নামবে। কষ্ট করে আন্দোলন সফল করে দেবে। পুলিশের মার খাবে। গুলি খেয়ে মারা যাবে। যানাজায় পর্যন্ত যাবেন না। সন্তানহারানো বাবা লোকটির কাধে শান্তনার হাতটি পর্যন্ত রাখবেন না। এ জন্য পঞ্জিকা দেখে তারিখ ঠিক করবেন। কেমন করে হবে?
ছেলেরা রাস্তায় নামবে। পুলিশ তাদের পেঠাবে গরু-ছাগলের মতো। মেরে হাত-পা ভেঙে দেবে শত শত ছেলের। যন্ত্রণায় কাতরাবে ছেলেগুলো। ফিরেও তাকাবেন না। তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবেন না। তাহলে তো হবে না।
পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে আরো কয়েকশ’। মামলা হবে তাদের বিরুদ্ধে। নেতারা গা ছাড়া ভাব দেখাবেন। ছেলেদের ছাড়িয়ে আনতে তড়িৎ উদ্যোগ নেবেন না। তাহলে কীভাবে হবে?
হরতালের আগে মাইকিং করতে থাকা ছয়টি ছেলেকে ধরে নিয়ে গেলো পুলিশ। আমি মুক্তাগাছার কথা বলছি। সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত হাজতে কাটিয়ে এরো তারা। কিন্তু সারাটা দিন ছেল্গেুলো কিছু খেলো কি না-খোঁজ নেয়নি কেউ। জেনেই বলছি আমি। কেউ একজন নেতা একটি কলা বা পাউরুটি নিয়েও যাননি। ভুল বুঝবেন না আবার। ভাববেন না তারা ব্যস্ত ছিলেন ছেলেদের জেল থেকে বের করার কাজে। এতো দরকার নেই তাদের। ঢাকা থেকে একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক, আমার অগ্রজ বন্ধু অনেক চেষ্টা-তদবীর করে ছেলেগুলোকে ছাড়িয়ে আনেন। এ কেমন অবস্থা?
ছয়\
মূল যে ইস্যুটি নিয়ে ছিলো এই হরতাল, নারী নীতি, সেটা নিয়ে অনেক কিছু বলবার দরকার আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। আলেমরা বলছেন, কুরআন বিরোধী কোনো আইন করতে দেয়া হবে না। সরকার বলছেন, কুরআন বিরোধী কোনো আইন আমরা করবোও না। তাহলে মৌলিক ক্ষেত্রে দূরত্ব তো নেই। নারীনীতি দেখা আছে আমার। শব্দের মারাতœক মারপ্যাঁচ রাখা হয়েছে। এখন, সরকার যেহেতু বলছেন, নারী নীতিতে সম্পদ বলতে উত্তরাধীকারের কথা বুঝানো হয়নি, তাহলে সামান্য একটি পদক্ষেপ নিলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একটি মাত্র বাক্য যুক্ত করে ফেললেই হয়। আলেমরাই বা কেনো এই প্রস্তাবটি করছেন না। বাক্যটি হতে পারে এমন: মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী নারীর প্রাপ্য সম্পদে নারীর পূর্ণ অধীকার নিশ্চিত করা হবে। ব্যস, তাহলেই তো হয়ে যায়।
ইদানিং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা করছেন তাফসীর স্টাইলে। আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। যে দেশের প্রধান নির্বাহী কুরআন শরীফের আয়াত নাম্বার বলে বলে জনসভায় বক্তৃতা করেন, সেই দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম হতে খুববেশি মনে হয় বাকী নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মূল্যবান তাফসীর শুনে আরেকজনের তাফসীর মনে পড়ে গেলো। একলোক ঘোষণা করলো নামাজ পড়ার দরকার নাই। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নামাজের কাছেও যেওনা’। তাকে বলা হলো, অই ব্যাটা, এই গাঁজাখুরি তথ্য তুই কোথায় পেলি? সে বললো, কেনো! পবিত্র কুরআন শরীফেই তো আছে। বলা হলো, চল দেখি তোর কোন কুরআন শরীফে এ কথা লেখা। সে কুরআন শরীফ খুলে দেখালো। লোকেরা দেখলো সত্যিই লেখা-‘হে ঈমানদারগণ তোমরা নামাজের নিকটবর্তীও হয়োনা’। লোকেরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ী করতে লাগলো। পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব কোথায় জানি দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। তিনি এসে দেখলেন ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, অই ব্যাটা! পৃষ্ঠা উল্টা। পৃষ্ঠা উল্টানো হলো। আয়াতের বাকী অংশ হচ্ছে ‘নেশাগ্রস্থ অবস্থায়’। অর্থাৎ ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা নামাজের কাছেও যেওনা নেশাগ্রস্থ অবস্থায়’।
আমাদের নেত্রীকে যারাই আয়াত সাপ্লাই দেন, তারা তাদের জন্য সুবিধাজনক অংশগুলোই কেবল নেত্রীর সামনে হাজির করেন। নেত্রী দেখেন, আরে! আল্লাহ তো দেখছি আমাদের মতোই বলছেন। তাহলে মাওলানা খামাখা চিৎকার করছে কেনো? আমরা বলি বাদশা নামদার। এ ব্যাপারে আরেকটু সিনসিয়ার হওয়াটাই কি ভাল না? এদেশের পোড় খাওয়া আলেম-উলামা পবিত্র কুরআনের একটু আধটু তরজমা তাফসীর করেই দিন কাটান। তাদেরকে বেকার করে দেয়া কি ঠিক হবে।
জনাবে আ’লাকে বলি, টেবিল টকিং এর মাধ্যমে বিষয়টি শুরাহার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। আর আন্দোলনে গেলে, ছেলেদের দায়দায়িত্ব নিন। আর সম্ভব হলে একলা চলো নীতি ত্যাগ করে মুরব্বীদের সাথেই থাকুন।