শনিবার, ২৪ মার্চ, ২০১২

২০৫৬ সালের একদিন


আজ থেকে ৫০ বছর আগে কেউ যদি বলতো, একসময় বাজারে হার্টের বাল্ব, কিডিনি, লিভার ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যাবে, কেউ বিশ্বাস করতো না। বলত, পাগল! নির্ঘাত পাগল। এই লোকটির মাথা যে পুরোটাই খারাপ, সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ---

ঠিক একইভাবে আজ থেকে ৫০ বছর পরে বিজ্ঞান হয়তো এমন অবস্থানে পৌছে যাবে, খোলা বাজারে মানুষের ব্রেইন কিনতে পাওয়া যাবে! সেই সময়ের একটি গল্প। অনুরোধ করছি ৫০ বছর পরের মানসিকতা নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য।

------------
--------------

এক ভদ্রলোক মার্কেটে গেছেন ব্রেইন কিনতে। যে কোনো কারণেই হোক, উনার মেজো ছেলের ব্রেইন ডেমেজ হয়ে গেছে। ছেলেটি এখন বদ্ধ উন্মাদ! তিনি ঢুকলেন একটি আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক ব্রেইন মার্কেটে। অত্যাধুনিক শপিং মল। ঝকঝকে পরিবেশ। কোথাও একটু ময়লা নেই। ফ্লোরে ভাত মেখে খাওয়া যাবে-অবস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সমাগমে মুখরিত পুরো মার্কেট। তিনি ঢুকলেন পিওর ব্রেইন সাপ্লায়ার সাইনবোর্ড লাগানো একটি মলে। এই প্রতিষ্ঠানের উপর তিনি আস্থা রাখলেন কারণ, সাইনবোর্ডের কোনায় বোল্ড করে লেখা ISO 9001-2000 সার্টিফাইড।

ভদ্রলোক দোকানে ঢুকতেই সেলসম্যান এগিয়ে এসে রেডিমেট একটি হাসি দিয়ে বলল, এক্সকিউজমি স্যার! কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?

খুশি হলেন ভদ্রলোক। এর আগে কেউ কখনো তাকে স্যার ডাকেনি। মনে মনে ভাবলেন, যাক, স্যার হবার মতো চেহারা তাহলে আছে তার। আজ অনেকদিন পর সূষ্টিকর্তাকে মন থেকে একটি ধন্যবাদ দিলেন। সেলসম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটি ব্রেইন চাই। ভালো একটি ব্রেইন। দেখান তো!

সেলসম্যান বিনীতভাবে বলল, স্যার, কোয়ালিটি কেমন হবে? আমাদের সংগ্রহে বিভিন্ন কোয়ালিটির ব্রেইন আছে। কেমন ব্রেইন চাই আপনার?
তিনি বললেন, ভালো কিছুই দেখান।
সেলসম্যান সুন্দর একটি বক্স নিয়ে এসে মেলে ধরল সামনে। এটা নিতে পারেন স্যার। ভাল মাল।
মেইড কোথায়?
এটি স্যার রাশিয়ান ব্রেইন।
দাম কতো?
এক লক্ষ টাকা স্যার, ফিক্সড।

ভদ্রলোক ভাবলেন, রাশিয়ান ব্রেইন , ভালোই হবার কথা। নেয়া যায়। তবুও অভ্যেস মতো জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আপনাদের কাছে এরচে’ ভালো ব্রেইন আছে ?

আছে স্যার, আরো ভালো কোয়ালিটিরও আছে। সে আরো চমতকার একটি প্যাকেট খুলে আরেকটি ব্রেইন বের করল। এবারেরটি আর বশি যত্ন করে রাখা হয়েছে। বলল, এটি নিন স্যার। আমেরিকান ব্রেইন। খাটি মাল। যে লোকের ব্রেইন এটি, জানা গেছে সেই লোক জীবনেও কোনো সমস্যায় পড়েনি । খুবই উন্নত কোয়ালিটি।
ভদ্রলোক ভাবলেন, আমেরিকান ব্রেইন, অবশ্যই রাশিয়ান ব্রেইন থেকে ভাল হবে। না জানি কতো দাম হাঁকায়! জিজ্ঞেস করলেন, এটির মূল্য কতো?
সেলসম্যান বলল, এটি একটু কম আছে স্যার। এই ধরেন ৮০ হাজার পর্যন্ত রাখা যাবে।

বিস্মিত হলেন লোকটি! যেটার মূল্য বেশি হবার কথা, সেটা বলছে কম! ব্যাপার কী! হিসাবে ভুলটুল করছে না তো! পরে হয়তো দেখা গেল, মাল প্যাকেট করে দেয়ার সময় ১ লক্ষ ৮০ হাজারের বিল ধরিয়ে দিচ্ছে!! সেই সাথে কিছুটা উৎসাহীও হয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, আচ্ছা, এরচে’ও ভালো কোনো মাল নেই?

আছে স্যার, এরচে’ও ভালো মাল আছে। এখন আপনাকে যেটা দেখাব, আপনার পছন্দ না হয়েই পারে না। সে অত্যন্ত যত্ন করে গ্লাসের ভেতরে রাখা গোল্ডেন চারকোনো একটি বক্স বের করে দিল। বলল, চোখ বন্ধ করে এই মালটি নিয়ে যান স্যার, বিশ্বের সেরা মাল।
এটি কোন দেশের?
এটি স্যার জাপানিজ।

অত্যন্ত খুশি হলেন লোকটি। এতক্ষণে ব্যাটা আসল মাল বের করেছে। জাপানিদের ব্রেইনেরচে’ উন্নত ব্রেইন আর হতেই পারে না। অরা অদের ব্রেইন খাটিয়ে কত কী আবিস্কার করে ফেলেছে! ইলেকট্রনিক পার্টস, মেশিনারিজ থেকে শুরু করে প্রযুক্তির এমন কোনো শাখা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে অরা সফল হয়নি। চোখ বন্ধ করে কেনার মতোই মাল। কিন্তু পরক্ষণেই বিব্রতকর ভাবনায় পড়ে গেলেন তিনি। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেলো পকেটে। ওয়ার্ল্ড ফেমাস জাপানি ব্রেইন। কিছুটা ভয়ের সাথেই বললেন, ভাই, এই ব্রেইনটি সর্বশেষ মূল্য কত? অর্থাৎ কত হলে দিয়ে দেবেন? একটু কমিয়ে বলবেন প্লিজ!!

সেলসম্যান বলল, আপনি মনেহয় স্যার লক্ষ্য করেননি আমাদের এই মার্কেটটা হল ফিক্সড প্রাইস মার্কেট। সঙ্গত কারণেই প্রথম দাম বলুন আর শেষ দাম , দাম কিন্তু অই একটাই। বেশি কথা বলে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত। এই ব্রেইনটি আপনি ৫০ হাজার টাকায় পেতে পারেন।

৫০ হাজার!!! বিস্মিত হলেন ভদ্রলোক। তাকালেন সেলসম্যানের দিকে। আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন ছেলেটি তাঁর সাথে ফাজলামো করার চেষ্টা করছে কি না! তাই যদি না হবে, তাহলে এমন উলটা-পালটা দাম বলছে কেনো! রাশিয়ান ব্রেইন বলল ১ লক্ষ টাকা। আমারিকান ব্রেইন যে কোনো বিচারেই রাশিয়ান ব্রেইন থেকে দামি , অথচ সে বলছে ৮০ হাজার! আবার জাপানি ব্রেইন বর্তমান বিশ্বে সবচে’ ভ্যালুয়েবল, সেটার দাম হওয়ার কথা অনেক বেশি অথচ বলছে মাত্র ৫০ হাজার!!! ঘটনা কি! ব্রেইনের দোকানে কাজ করতে করতে এই ব্যাটার নিজেরই ব্রেইনের কোথাও সর্ট সর্কিট হয়ে গেলো কি না- কে জানে! অসম্ভব না!

নিজেকে সংযত করলেন ভদ্রলোক। বললেন, এই ছেলে, আমি তো তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আপাতত সেটার চেষ্টাও করছি না। তাহলে হয়তো দেখা যাবে একটা না, এজ জোড়া ব্রেইনই কিনতে হবে। যা হোক, বেশি কথা বলে লাভ নেই। তোমাদের কাছে সবচে ভালো কী আছে সেটাই বের করো। অর্থাৎ ইনটেক পিওর কিছু থাকলে বের করে ফেলো। খামাখা সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। (মেজাজ খারাপ হওয়ায় ভদ্রলোক আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছেন, খেয়ালই করেননি!)

বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসল ছেলেটি। যেনো এই পৃথিবীর তৃ্তীয় শ্রেষ্ট বোকার সাক্ষাত পেয়েছে সে! বলল, আপনি ইনটেইক ব্রেইন চান আগে বলবেন না! আসুন আমার সাথে।

সে ভদ্রলোককে নিয়ে ঢুকলো দোকানের ভেতরের একটি রোমে। অত্যন্ত মনোরম একটি ফ্রিজ খুলে স্বর্ণের বক্সে রাখা একটি ব্রেইন বের করে বলল, এই নিন স্যার, খাটি মাল। সম্পূর্ণ ইনটেক। একদম। গায়ে একটু আচর পর্যন্ত লাগেনি। এরচে’ ফ্রেশ কোনো মাল পৃথিবীতে আর পাবেন না।

ভদ্রলোক মনে মনে ভাবতে লাগলেন, বিশ্বের সেরা এই ব্রেইনটি কিনতে হলে অবশ্যই তাকে তাঁর বাড়িটি বিক্রি করতে হবে। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, এটির দাম জানি কতো---??
এটি একটু বেশি স্যার। বুঝতেই পারছেন অক্ষত মাল। এটার মূল্য ৫ লক্ষ্য টাকা।
স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন তিনি। বাড়ি বিক্রি না করলেও চলবে। ব্রেইনটির ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠলেন তিনি। এমন একটি ব্রেইন তাঁর ছেলের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া গেলো আর কী চাই!! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই মহা মূল্যবান ব্রেইনটি কোন দেশের?
সেলসম্যান নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলো, এটি স্যার বাংলাদেশি ব্রেইন!!

সকল আগ্রহ মাটি হয়ে গেলো । এই ছেলে যে ফাজলামো করছে, আর কোনো সন্দেহ নেই। রাগে ঘামতে শুরু করলেন তিনি। এতোক্ষণ ধরে উল্টা-পাল্টা দাম বলছে। আর এখন যেটা তিনি মাগনা দিলেও নেবেন কি না সন্দেহ, সেটার দাম বলছে ৫ লাখ! ফাজলামোরও তো একটা সীমা থাকা দরকার। পাড়ার কোনো ছেলে এমন করলে এতক্ষণে থাপড়ে দাঁত ফেলে দিতেন। এখানে এটি সম্ভব না। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা আছে। সিকিউরিটিও টাইট।

অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বললেন, দেখো ছেলে, আমি তোমার বাবার বয়সী। আমার সাথে ইয়ার্কি করা তোমার শোভা পায় না।
সে বলল, আমি আপনার সাথে মোটেও ইয়ার্কি করছি না স্যার। আপনি ব্রেইন দেখতে চেয়েছেন, আমি দেখিয়েছি। আপনি দাম জানতে চেয়েছেন, বলেছি। যেটার যে দাম সেটাই বলেছি। আর একটি কথা , এখানে প্রতিটি পণ্যের যথাযত মূল্যই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে।

এবারে খানিকটা বিব্রত হলেন ভদ্রলোক। ছেলেটির কথা বলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে সে ইয়ার্কি করেনি। কিন্তু ন্যায্য মূল্যই যে বলেছে, সেটাই বা মানবেন কী করে? তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন দাম বলছে উল্টা-পাল্টা! অবশেষে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমাকে ব্রেনগুলোর দামটা একটু ব্যাখ্যা করো তো! দেখি তোমাদের মাপকাটিটা কেমন!

ছেলেটি বলল, দেখুন স্যার, প্রথমে আপনাকে দেখিয়েছি রাশিয়ান ব্রেইন। এটি একটু ব্যবহৃত, ব্যবহারের ফলে একটু ক্ষয় হয়েছে, দাম ১ লক্ষ টাকা। তারপর দেখানো হয়েছিল আমেরিকান ব্রেইন। সেটি আরো বেশি ব্যবহৃত, আরো বেশি ক্ষয় হওয়া, তাই দামটাও একটু কম, ৮০ হাজার। তারপর জাপানি ব্রেইন, ৫০ হাজার বলেছিলাম না? ঠিকই আছে। ওটা অত্যাধিক ব্যবহৃত ব্রেইন। জাপানিরা বলতে গেলে জন্মের পরের দিন থেকেই ব্রেইন ব্যবহার করা শুরু করে দেয়। বুঝতেই পারছেন কত বেশি ব্যবহৃত মাল এটি। তাই দামটাও কম। আর বাংলাদেশি ব্রেইন!

বাংলাদেশি ব্রেইনের দাম সবচে বেশি কারণ, জীবনে এই ব্রেইন কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। বাঙালিরা কখনো ব্রেইন ব্যবহার করে না। জন্মের সময় সাথে করে নিয়ে আসা আল্লাহর দেয়া ব্রেইনটি অক্ষত অবস্থায় নিয়েই কবরে চলে যায়। তো জীবনেও ব্যবহার না করার ফলে ব্রেইনটি থেকে যায় সম্পূর্ণ অক্ষত। একদম নতুন। এ জন্যই এটির মূল্য সবচে বেশি।
------------
----------------
ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত উনার ছেলের জন্য ব্রেইন কিনেছিলেন কি না, কিনলেও কোন দেশেরটা , সেটা আমাদের জানা জরুরি না। আমরা ভাববো বাংলাদেশি ব্রেইন নিয়ে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন